ঢাকা, এপ্রিল ২৫, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৯:০১ pm

সূর্য কি ওঠে, নাকি সূর্য ডোবে : মহাজাগতিক পথচলা

| ১৮ চৈত্র ১৪২৬ | Wednesday, April 1, 2020

সূর্য কি ওঠে, নাকি সূর্য ডোবে : মহাজাগতিক পথচলা
প্রশস্ত এক রাস্তা ধরে রিকশা দিয়ে এগিয়ে গেলেও মিনিটবিশেক লাগে পৌঁছতে। জায়গাটা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের নিকটবর্তী জেলেপাড়ার কাছে; খাঁড়ির মতো একটা জায়গা; মাঝে মাঝে হাওয়া এসে কেমন এলোমেলো করে দেয়। যেখানে অজস্র জেলে নৌকা ভাটায় দাঁড়িয়ে থাকে আর জোয়ারে চলে যায় সমুদ্রের গভীরে, মাছ ধরতে। রাস্তার কিছুটা প্রারম্ভে চট্টগ্রামের কাট্টলী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। বিজ্ঞান বক্তৃতা (কসমিক ক্যালেন্ডার বিষয়ে) করতে হয়েছিল ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাঝে। সময়টা ছিল সকাল ১১টায়, ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল। খোলা মাঠে রোদের মধ্যে অনুষ্ঠানটি হওয়ায় মাল্টিমিডিয়া তেমন কাজে আসেনি। তবে অনুষ্ঠানটি ভীষণ প্রাণবন্ত হয়েছিল। অনেক ধরনের প্রশ্ন আমার দিকে ছুড়ে মেরেছিল তারা। বক্তৃতার পর বিকালে আমি যখন জেলেপাড়ায় নৌকাগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের শেষ আলো চলে যাওয়া দেখছিলাম, তখনই শিক্ষার্থীদের করা অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন আমাকে ঘিরে ধরেছিল; যেন পিথাগোরীয় সময়ের আবেগ আর ঈজিয়ান সাগরের ঢেউ, লাল আভায় মোড়ানো এক পৃথিবী।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়া এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেছিল : তুমি বলছ সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে আর এই কথাটি বলার জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের ওপর নির্যাতন চলেছে, জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মেরেছে, অথচ আজও আমরা যখন বলি সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে; তা তো এই কথাই বলে সূর্যের চারদিকে নয়, পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে। আমি চুপ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি; অনুভব করি বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে পৃথিবীর সংস্কৃতিগুলোর ব্যর্থতা। কেননা এখনো সে রকম বাক্যবিন্যাস আমাদের অভ্যাসে আনতে পারেনি যার অর্থ হবে, ‘সূর্যের চারদিকেই পৃথিবী ঘোরে; বুঝতে পারবে প্রতিদিন সূর্যের মুখোমুখি হই, ১২ ঘণ্টা কাটিয়ে সূর্য থেকে সরে গিয়ে রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করি, ১২ ঘণ্টা পর সূর্যের মুখোমুখি হয়ে দিনের আলোর মুখোমুখি হই।’ অথচ এটাই ছিল কেন্দ্র থেকে বিকেন্দ্রীকরণের দিকে যাওয়ার অভিযাত্রা। শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা থেকে সরে গিয়ে সবার একজন হয়ে ওঠার যাত্রা।

সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আমি যেন ঢেউ গুনছিলাম, নতুন করে বেরিয়ে পড়ার জন্য। সাংস্কৃতিক দর্শনের অগ্রপথিক ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ এই কথাগুলোর এক ধরনের প্রারম্ভিক সূচনা ঘটায়। ২০০৭ সালে নালন্দার সঙ্গে সংযুক্তি আমাকে শিশুশিক্ষা নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শুনেছিলাম নালন্দা এক ধরনের প্রকৃতঘনিষ্ঠ করে শিশুদের বড় করে তুলতে চায়, বুঝেছিলাম মাঠহীন, গাছহীন কংক্রিটের মধ্যে কাটানো শৈশবকে মুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা। ভালো লেগেছিল। কিন্তু কালচারালি ইন্টিগ্রেটেড কথাটার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না, যদিও জীবন বিকাশের নতুন কোনো প্রচেষ্টার একটা ইঙ্গিত ওয়াহিদুল হকের কণ্ঠেও আমি শুনেছিলাম। দুর্ভাগ্য বলতে হবে, এগুলো স্পষ্ট হওয়ার আগেই উনি প্রয়াত হন।

একটা স্কুল আসলে কী। কীভাবে এর মধ্য দিয়ে একটি শিশু তার জার্নিটা শুরু করবে? অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির ঘুঁটি হিসেবে বড় না হয়ে যাতে সে মানব সাগরের তীরে পৌঁছতে পারে? একটা বিষয় আমার কাছে সব সময় পরিষ্কার ছিল, শ্রেষ্ঠত্বের প্রবণতা জাহির করার জায়গাগুলো থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে না-শিক্ষা, না-সমাজ মানবিক হয়ে উঠবে। শ্রেষ্ঠত্ব হলো কেন্দ্রীকরণের প্রচেষ্টা আর সবার একজন হয়ে ওঠা হলো বিকেন্দ্রীকরণের পথ, মানবিকতার পথ। মস্তিষ্কেও গভীরে এই কেন্দ্রীকরণের বিষয়টি প্রোথিত। বিবর্তনে উদ্ধৃত এই অংশের অসঙ্গতিগুলোকে দূর করতে না পারলেও যেই ক্ষমতার শীর্ষে যাক, যেই রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধান হোক তাতে কিছু আসে যাবে না। প্রচলিত একটা প্রবাদ তো আছেই, ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।’ তখনই লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষাকে যুক্ত করার তাৎপর্য আরও স্পষ্ট হতে থাকে।

এর অর্থ হচ্ছে অতীতে মানুষের যে জীবনযাপন যার কারণে আমরা এতদূর এসেছি তা সংগঠিতভাবে শিক্ষায় সম্পৃক্ত করা। তাই হচ্ছে কালচারালি ইন্টিগ্রেশন বা সাংস্কৃতিকভাবে সম্পৃক্তকরণ বা জোড়াহীন এক পথ। মস্তিষ্কের অসঙ্গতিগুলোকে দূর করার একটা উপায়ও। তাই আইনস্টাইনও ১০০ বছর আগে বলে গেছেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে সর্বাধিক জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে স্কুলকে ব্যবহার করার চেয়ে স্কুলকে তরুণদের মধ্যে সেসব গুণ ও দক্ষতা গড়ে তোলার প্রতি জোর দিয়েছেন। কেননা সহনশীলতা, নমনীয়তা নিয়ে মানবিকবোধ জাগ্রত করতে না পারলে নানা অঘটন ঘটিয়ে আমরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলতে পারি। যেমন জঙ্গিবাদ, জীবাণু অস্ত্র, সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এই মানবীকরণের পদক্ষেপগুলোকে এভাবে চিন্তা করা যেতে পারে :

স্কুল সবার সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করবে : যখন একটা শিশু অঙ্কুর বা প্রাক প্রাথমিকে ভর্তি হয় তখন সে অনেকের সঙ্গে জীবনের যাত্রায় শামিল হয়। হৈচৈ করে, খেলাধুলা চিৎকার-চেঁচামেচি করে, ভাবের আদান-প্রদান করে। এর মধ্য দিয়ে তারা এক ধরনের বিনিময় ঘটায়। বুঝতে শুরু করে একা ও অনেকের সঙ্গে মিলে চলার পার্থক্যটা। শিক্ষাকর্মী বা শিক্ষকরা শুধু নজর রাখবেন, কোনো অঘটন থেকে বিরত রাখায় সচেষ্ট থাকবেন।

এগুলোর পাশাপাশি শিক্ষাকর্মীরা ধীরে ধীরে ক্লাস বা পাঠকক্ষের মতো পরিবেশ তৈরি করতে থাকবেন, যাতে শিক্ষার্থীরা সবার সঙ্গে বসে শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীর কথা শুনতে উদ্বুদ্ধ হয় অথবা কোনো শিক্ষার্থী সবার সামনে ফর্মাল কথা বলার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে তার মধ্যে যেন এই প্রস্তুতি গড়ে ওঠে: ক্লাসে সবাই সুশৃঙ্খলভাবে বসবে, নিজের ক্লাসটা ভালো না লাগলেও অন্যের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে নজর রাখবে, প্রশ্নোত্তরের ব্যাপারে শিক্ষার্থী একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছতে চেষ্টা করবে।

এভাবে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের এই সিদ্ধান্তে আনতে হবে, আমাদের চিৎকার-চেঁচামেচি, খেলাধুলা, গল্পগুজবের অভিজ্ঞতা, পাঠচর্চা, প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্ন বিনিময় করার সুশৃঙ্খল জায়গা হচ্ছে এই শ্রেণিকক্ষ, নিজেদের উন্মোচন বা এক্সপ্লোরেশনের জায়গা এটা। এগুলোর মধ্য দিয়ে বোঝাপড়া, সহনশীলতা অর্থাৎ মিলেমিশে থাকার শক্তি ও উপলব্ধিটা বাড়বে।

বিবর্তনীয় জীববিদ্যা বলছে, যে পরিবর্তন ও অভিজ্ঞতা ও অন্যকে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আমরা হমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি এখানে এসেছি। তাতে এই মিলেমিশে থাকার গুণগুলোর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। স্কুলিংয়ের এই চর্চার মধ্য দিয়ে উল্লেখিত গুণগুলো ধীরে ধীরে অর্জন করতে হবে।

মেমোরাইজেশন : মানুষের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে ভুলে যাওয়া। মানবজাতির অর্জনই হচ্ছে এই ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতিধারণের সংগ্রাম। সে যত বেশি পেছনের ঘটনাবলিকে মনে রাখতে পারবে, তার চলার পথ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি ততবেশি সহনশীল ও প্রশস্ত হবে, ভবিষ্যৎকে সে নির্মাণ করতে পারবে তত বেশি আপন আলয়ে। মানবিক জীবনের বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করবে সেসব স্মৃতিধারণ। তা ছাড়া প্রত্যেকটি শিশু ভবিষ্যতের মানুষ। আজকের যে বাস্তবতা তা ভবিষ্যতে না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সেটা আমাদের শিক্ষায় গুরুত্বসহকারে নিতে হবে।

নালন্দা ছাড়াও অরণী, সহজপাঠ, ফুলকী এবং তক্ষশীলার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অল্পবিস্তর যাওয়া হয়েছে। এখানে শিশুদের নানা ধরনের সৃজনশীল কাজ করানো হয় প্রথম থেকে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ স্কুল পর্যন্ত শিশুরা তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক যুগের একটা সময় অতিবাহিত করে। ১২ বছরের প্রত্যেক পর্বে স্কুলে তার কর্মকা-ের কম করে একটিসহ মোট ১২চিহ্ন (লেখা বা ছবি ইত্যাদি) তাকে অ্যালবামের আকারে বিদায় প্রাক্কালে দেওয়া গেলে সে নিজের বেড়ে ওঠাটা দেখতে পাবে। এতে স্কুলের প্রতি, সমাজের প্রতি যে বোধ তৈরি হবে তা সমাজ ও নিজের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করবে।

প্রত্যেক শিশুর চারপাশের পরিবেশ ও ঐতিহ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া : ২০০৯ সাল। নিঝুম দ্বীপের গামছা খাল। এই খাল দিয়ে প্রতিদিন আমরা দুজন পার হতাম। আর ৮ বছরের এক শিশু নৌকার হাল ধরত। সে গান গাইত ‘আমি নিঝুম TM^ীপের মাঝি।’ তার উদাত্ত কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসত। যেন নিঝুম দ্বীপ কাঁপত। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি বড়ো হয়ে কী হবে। সে স্বচ্ছ দৃষ্টি মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমি মাঝি হব। যেন মাঝি হওয়ার মধ্য দিয়েই নিজেকে উন্মোচন করতে চায়, জগৎকে জানতে চায়।

আমাদের শিক্ষিত সমাজেও কেউ নাবিক হতে চায়, কেউ ডাক্তার হতে চায়, প্রকৌশলী হতে চায়; কেউ বিজ্ঞানী হতে চায়। নিঝুম দ্বীপের সেই শিশুকে, কেন সে মাঝি হবে জিজ্ঞেস করলে সে হেসেছিল। আমি বুঝেছিলাম প্রত্যেকটি শিশুর একটা পারিবারিক পরম্পরা থাকে, পরম্পরা থাকে ঐতিহ্যের। তার চারপাশটা ঘিরে সে চিন্তা নানা পরিবর্তন ্ও বিকাশ সাধন হয়। তার ভিত্তিতে এই চাওয়া। অতএব একটা শিশুকে ভর্তি করার সময় কেস হিস্ট্রিটা ঠিকমতো নিতে পারলে পরিবার ও স্কুলের মধ্যে ইন্টিগ্রিটি বা অবিচ্ছেদ্যতা তৈরি করবে। এটা স্কুলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর সঙ্গে আমাদের সমাজে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি নাবিক হওয়ার ব্যাপারে যে লাভক্ষতির হিসাব কাজ করে তার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ওরকম মিথস্ক্রিয়া থেকে যদি এ রকম হওয়ার ইচ্ছা জাগে তা মানবিক এবং মহৎ। তাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

শিশু বয়সে এই ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে যেতে পারলে মানবিক সমাজ তৈরির পথ প্রশস্ত হবে। মানুষ অনিশ্চয়তা থেকে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসতে পারবে। শিক্ষায় প্রথম থেকেই একটা শিশুকে শ্রেষ্ঠত্ব এবং অন্যদের থেকে বেশি মেধাবী ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার বীজ বপন করা হয়, তার থেকে রক্ষা করতে পারবে। পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া, সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সুষম মানবিক সমাজ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করবে।

লেখক: আসিফ
বিজ্ঞান বক্তা ও লেখক; সম্পাদক, মহাবৃত্ত