ঢাকা, অক্টোবর ১৪, ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৪:২৪ pm

ভেনাস ট্রানজিট ও বিজ্ঞানমনস্কদের পথচলা

| ২৬ অগ্রহায়ন ১৪২৪ | Sunday, December 10, 2017

ভেনাস ট্রানজিট
ততক্ষণে রাত ভারী হয়ে গেছে অনেকখানি। অবশ্য ঢাকার আকাশে রাতের রূপ স্বরূপে থাকেনা। অনেক উপরে তারা ভরা আকাশ। কিন্তু মাথার ঠিক উপরেই রাস্তার কৃত্রিম বাতি। শহুরে চোখে তাই রাতের তেমন কোনো আবেদন থাকে না। সেদিনও ছিল না। সেদিন মানে ৫ জুন। রাত দশটা পেরিয়ে গেছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝরছে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গেট থেকে দ্রুতগতিতে দুজন বেরুলেন। হন্তদন্ত হয়ে দিলেন দৌড়। রাস্তার ঠিক ওপারে আরেকজন বসে আছেন মোটর বাইকের ক্লাস চেপে। ওই চালকের কাছে গিয়ে একটা ব্যাগ দিয়ে আসিফ বললেন, ‘যেভাবেই হোক রাতেই ডেন্টিস্ট জেনিথের কাছে এই চশমাগুলো পৌঁছে দিবেন, প্লিজ।’ চশমা? দাঁতের ডাক্তারের কাছে চশমা চালান? প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। এই ফাঁকে আসিফ আবার দৌড় দিয়ে ফিরছেন টিটি কলেজের ভেতর। সেকেন্ডে তিনি বড় জোর ৩ থেকে ৫ মিটার যেতে পারেন। অথচ বিজ্ঞান বক্তা আসিফ নিশ্চয়ই জানেন, আকাশে শুকতারাটা এই এক সেকেন্ডে ৩৫ কিলোমিটার গতিতে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে আসছে। এই হিসেবে ভোর চারটা ১০ মিনিটে সূর্যের সামনে চলে আসবে ‘পিচ্চি’ গ্রহটা। যদি সূর্যে তখন চোখ রাখা যায়, দেখব কালো একটি বিন্দু। ঠিক যেন দুধসাদা তরুণীর গালে থাকা কালো এক তিল! বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আরেকটু আশ্চর্য হব- মহাজাগতিক ওই তিলটি একটু একটু করে ‘হেঁটে’ যাচ্ছে সূর্যের শরীর বেয়ে! এ এক নয়ননন্দন মহাজাগতিক দৃশ্য। সকাল প্রায় ১১টা পর্যন্ত সূর্যের সামনে দিয়ে এভাবেই ক্যাটওয়াক করে সরে যাবে আমাদের চাঁদের চেয়েও ছোট ওই গ্রহটা। কিন্তু খালি চোখে তো সূর্যে চাওয়া যায়না। তাই? হ্যাঁ, দরকার তাই চশমা। সৌরচশমা। নারায়নগঞ্জে জেনিথের কাছে আসিফের পাঠানো ওই চশমাগুলো ছিল সৌরচশমা। সাংস্কৃতিক জোট আর ডিসকাশন প্রজেক্ট মিলে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে বরফ কল ঘাটে উৎসুক মহাকাশ-দর্শকদের জন্য পাঠানো হয়েছিল চশমাগুলো। কিন্তু টিচার্স ট্রেইনিং কলেজে কি চশমা বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়? না, তা নয়। ওখানে, অডিটরিয়ামে বিকেলে একটা কর্মশালার আয়োজন করেছিল ডিসকাশন প্রজেক্ট।
dsc09702.JPG
এরপর সদয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় বিজ্ঞানকর্মীরা অডিটরিয়ামে বসেই চশমা বানাতে থাকেন। যোয়েল কর্মকার স্টেপলারের পিন দিয়ে ১৪ নম্বর ওয়েলডিং গ্লাস গাঁথছেন নকশা করা কাগজের চশমায়। জাহাঙ্গীর সুর চশমার ছাঁচের বাইরে কাগজের অতিরিক্ত অংশ ছেটে ফেলছেন। আসিফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাঁজ করে দিচ্ছেন চশমাগুলো। কিছুক্ষণ আগে এই দলে আরও ছিলেন শাহাবুদ্দীন সামি, অরণ্য আর সিরাজুম মনিরা ইরিনা। আসিফের ছেলে অরণ্য। সবার সঙ্গে চশমা বানানোয় মেতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল সেও। ভারতের ব্যাঙ্গালর থেকে পদার্থবিজ্ঞানে সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করেছেন ইরিনা। এই শুক্রচলনকে কেন্দ্র করে তার ভেতর তৈরি হয়েছে অন্যরকম অনুভূতি। ‘জ্যোর্তিবিজ্ঞানী’ বলে ডাক দিলে সাড়া পেলাম, ‘না না, ঠিক তা নয়। তবে বলতে পারেন, রেডিও সায়েন্টিস্ট।’ ক’দিন আগে তিনি রেডিও টেলিস্কোপ তৈরির প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন নাসার সহযোগিতায়। তো, ইরিনা তিন দিন ধরে রামপুরা-বাড্ডার যে বিশাল ফাঁকা মাঠ, ওখানে ‘গবেষণা’ চালাচ্ছেন, কী-করে সূর্যের ছায়াকে একটা কালো তাবুর ভেতর সাদা পর্দায় ফেলা যায়।
ইরিনা তিন দিন ধরে রামপুরা-বাড্ডার যে বিশাল ফাঁকা মাঠ, ওখানে ‘গবেষণা’ চালাচ্ছেন, কী-করে সূর্যের ছায়াকে একটা কালো তাবুর ভেতর সাদা পর্দায় ফেলা যায়
এতে করে অনেক দর্শক মহা-দৃশ্যটা দেখতে পাবেন। পাশাপাশি কিছু পিন হোল ক্যামেরাও বানাতে চান ইরিনা। দরকারি সব যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে। সামি রাতেই সেসব দিয়ে অন্তত কালো তাবু বানিয়ে ফেলবেন। তাই বন্ধু সখাকে সঙ্গে নিয়ে সামি চলে গেছেন রামপুরায় ইমপেরিয়াল কলেজ ক্যাম্পাসে। ওখানেই শুক্রের চলন দেখার জন্য ডিসকাশন প্রজেক্টের প্রধান ক্যাম্প বসবে। কলেজের শিক্ষক ও আবৃত্তি শিল্পী সুমনা বিশ্বাসের কাছে আমরা ঋণী, তার সহযোগিতায় অনেক কিছুই সহজে সম্পন্ন করেছি আমরা।
যা বলছিলাম, আসিফ টিটি কলেজের ভেতর ঢুকলেন। তারপর আবার চশমা বানানো। বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া- সারাদেশে অনেক চশমা লাগবে তো। ডিসকাশন প্রজেক্টের সহযোগী সংগঠনগুলোর বিজ্ঞানকর্মীরা অধীর আগ্রহে আর কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে চশমার জন্য। মহাজাগতিক দৃশ্য অবলোকনের জন্য। অন্তত সূর্যের মঞ্চে শুক্রের এমন ক্যটওয়াক আগামী ১০৫ বছর আর একটিবারও দেখা যাবেনা। পৃথিবীর কোত্থাও থেকে না। সুযোগ তাই হেলায় হারায় কে! তাই তাড়া ছিল বেশ। রাতের গাড়িতেই চশমা পাঠাতে হবে। কুষ্টিয়া থেকে রফিক বারবার ফোন করছেন। তার ইয়ুথ সায়েন্স গ্র”পের বিজ্ঞানকর্মীরা চশমা আদৌ পাবেন কি না। রাত সাড়ে এগারটার মধ্যে বাসের হেলপারের কাছে চশমা তুলে দিতে না পারলে সব চেষ্টাই জলে যাবে। হাঁটুর ওপর মোবাইলে এক কান গুঁজে দিয়ে চশমা বানাতে বানাতে জাহাঙ্গীর বলছেন, ‘লুৎফর, হতাশ হইওনা। রাখছি। পরে ফোন করছি।’ রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে লুৎফরের নেতৃত্বে বসবে আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগারের এই ক্যাম্প। সংগঠনটি আরও কয়েকটি ক্যাম্প করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে জমিনপুরে এবং ইকবালের তত্ত্বাবধানে রহনপুরে তাদের ক্যাম্প। আরেকটি ক্যাম্প বসবে ঢাকার উত্তরায়, সালুম হায়দারের নেতৃত্বে। এদিকে বরিশালে ক্যাম্প করছে বিজ্ঞান সংগঠন কসমিক কালচার, ব্রাম্মনবাড়িয়ার সপ্তর্ষি বিজ্ঞান ক্লাব এবং পাবনার বন্ধুসংঘ। উষার তত্ত্বাবধানে খুলনায় ডিসকাশন প্রজেক্টের আরেকটি ক্যাম্প বসছে।
সোয়া এগারটা পর্যন্ত চলল চশমা বানানোর কাজ। এরপর যোয়েল ও জাহাঙ্গীর বাসে উঠে পড়লেন। কল্যাণপুর বাস কাউন্টারে। সব জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন চশমা। রাতে তখন বাসায় ফেরার সুযোগ ছিল না জাহাঙ্গীরের। তাছাড়া ঢাকার জন্য তো কোনো চশমা বানানোয় হয়নি! তাই দুজনার গন্তব্য মিরপুরে যোয়েলে বাসায়। রাত সোয়া একটায় বাসায় পৌঁছে যোয়েল রান্না চড়ালেন। জাহাঙ্গীর চশমা বানাতে লাগলেন। মাঝখানে মিনিট দশেক খাবার বিরতি দিয়ে ভোর চারটা পর্যন্ত চশমা বানালেন তারা। ইতিমধ্যে ইরিনা চলে গেছেন মূল ক্যাম্পে। জাহাঙ্গীর আর যোয়েল চশমা নিয়ে ইমপেরিয়াল ক্যাম্পে পৌঁছলেন সকাল সাড়ে ৬টার দিকে। অনেকে দর্শক জড় হয়েছেন। মা খালেদা ইয়াসমিন ইতির সঙ্গে শিশু বিজ্ঞানকর্মী অরণ্যও চলে এসেছে স্পটে। কিন্তু তখনও সূর্য পুরো মেঘে ঢাকা। কড়া কিরণ না থাকলে ইরিনার কালো তাবুর সাদা পর্দা কোনো কাজে আসবে না। শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছিল। এটা আগেভাগেই আঁচ করেছিলাম আমরা। আসিফকে বলেছিলাম, ‘কিন্তু ইরিনার মধ্যে যে দীপ্তি দেখা যাচ্ছে এটার মূল্যই অনেক। ওঁ যা করতে চান করুন।’ সূর্য উঠছে না দেখে আমরা কলেজের একটা কক্ষে ভিডিওচিত্র প্রদর্শনী, আসিফের বক্তৃতা, প্রশ্নোত্তর- ইত্যাদি চালিয়ে গেলাম। এর মধ্যে আমাদের কাছে প্রথম ফোন এলো রহনপুর থেকে। ইকবালের কন্ঠে উচ্ছ্বাস, ‘দারুণ। আমরা দেখছি। ভীষণ ভালো লাগছে। এখানে সবাই তো পাগল হয়ে যাচ্ছে।’ কিছুক্ষণ বাদেই ফোন এলো রাজশাহীর পদ্মার পাড় থেকে, ‘যারা রাতে পাগল বলছিল, তারাই এসে চশমা চেয়ে সূর্য দেখছে। ওই কালো তিলটা দেখছি। আজীবন মনে থাকবে।’ এভাবে ডিসকাশন প্রজেক্টের সহযোগী সংগঠনগুলো থেকে একে একে ফোন করে তাদের আবেগ-অনুভূতি জানাচ্ছিল। আমরা ঢাকায় শুক্রচলন দেখতে পেলাম পৌনে নয়টার দিকে। এরপর আবার মেঘের আড়ালে সূর্যের লুকোচুরি শুরু হলো। তার মধ্য দিয়েই চশমায় চোখ রেখে আমরা দেখতে থাকলাম অনিন্দসুন্দর সেই দৃশ্য যা ২য় বার দেখার সুযোগ হয়ত আমাদের অনেকেরই হবে না।
youth-science-photo-3.jpg
youth-science-photo-2.jpg
06062012481.jpg

ডিসকাশন প্রজেক্ট বিজ্ঞানভিত্তিক সম্প্রদায় গড়তে চায়
এই লক্ষ্যেই এবারের আয়োজন ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ডিসকাশন প্রজেক্ট চেষ্টা করেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণ প্রজন্মও যেন এই মহাজাগতিক ঘটনা অবলোকনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই সংগঠন মনে করে, এ ধরনের পর্যবেক্ষণে মহাবিশ্ব, সৌরজগৎ ও প্রাণের উদ্ভব সম্পর্কে মানুষের মনে আগ্রহ গড়ে ওঠে। তৈরি হয় এক ধরনের সাংস্কৃতিক বোধ। এসব অনিন্দসুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে কুসংস্কারমুক্ত একটি সমাজ। হয়তো এই পথ ধরে ধীরে ধীরে নতুন প্রজš§ জ্যোতির্বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবে রাধা-গোবিন্দ, চন্দ্রশেখর কিংবা মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীদের পথ ধরে।

লেখক: জাহাঙ্গীর সুর, বিজ্ঞান কর্মী ও সাংবাদিক
৬ জুন, ২০১২ এ সংঘটিত ভেনাস ট্রানজিট অবলম্বনে