ঢাকা, অক্টোবর ১৪, ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৫:৪৬ pm

অভয় বাজে হৃদয় মাঝে: চাকরি সন্ধানের চাইতে অনিশ্চিত জীবন ভাল

| ২৭ ফাল্গুন ১৪২১ | Wednesday, March 11, 2015

অভয় বাজে হৃদয় মাঝে: চাকরি সন্ধানের চাইতে অনিশ্চিত জীবন ভালবাংলাদেশে সাহসী মানুষের দেখা পাওয়া দুষ্কর। আছে নিশ্চয়ই, আমাদের দৃষ্টি চলে না সেদিকে, অতদূর পর্যন্ত। পঁচাত্তরের হত্যাযজ্ঞের প্রবল প্রতিবাদ হয়নি, কেউ মারা যায়নি প্রতিবাদ করতে গিয়ে। কাগজগুলো কি করেছে? সত্য কথা লিখবার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। সাতই নভেম্বর একটা নৃশংস উন্মত্ততায় ঢাকল দেশ, সৈনিকরা তাদের অফিসার মারছে। কেউ তখনও সাহস করে এর বিরুদ্ধে কিছু বলেনি, এখনও বলে না। উল্টো তাকে সিপাহী-জনতা বিপ্লব বলে অভিনন্দন করাই চলে এসেছে বহুদিন। মুক্তিযুদ্ধের চার বিজয়ী নেতা নিহত হলেন, জেলে, সরকারী হেফাজতে। বাংলাদেশ দিব্যি চলে যাচ্ছে তার কোন সুরাহা না করে। জিয়াউর এসেছেন, গদি নিশ্চিত করতে সংবিধানের নাক-কান কেটেছেন, হত্যা করে গেছেন অকাতরে, শ’য়ে শ’য়ে, অনেকে বলে হাজারে হাজারে। না, প্রতিবাদ নেই কোথাও। গণহত্যার দেশে এই রকমই হয়। তিরিশ লাখ লোক খুন হয়েছে যে দেশে সেই দেশে আর সাহস থাকে না। থাকে কাপুরুষতা। বাংলার মানুষ পঁচাত্তর থেকে এই পর্যন্ত কেবল মেনে নিতে নিতেই এসেছে। যা কিছু উদ্যোগ এখানে তা অপরাধী নামের বিকৃত মাথার মানুষের, কোন সুস্থ মানুষ ঢিলটি ছুড়তে চায়নি কাক তাড়াতে। কিন্তু তবু ভাবি এই রকম দেখাটা ভুল। একটা সমাজ কি চলতে পারে কোনই সাহসী মানুষ না থাকলে? আমিই দেখতে পাই না। হয়ত আমার চোখের ভুলে। আর সাহসও তো কত রকম হয়, সব রকমের সাহস চোখে পড়বার মতোও নয়, তাই পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ কি শেখাননি উচ্চকন্ঠ বীরদর্পই কেবল সাহসের পরিচয় নয়। যে কেরানি সাহেবে অপমান নীরবে হজম করে কাপুরুষের চেহারা পেল, তার তো সাহসের ত্রে ছিল অন্যত্র। তার আর্ত কন্যাটির সেবায়।
আসিফের মধ্যে আমি দেখি একটি অত্যন্ত সাহসী মানুষকে। তিনি কখনও পুরো নাম ব্যবহার করেন না। বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। এখন বহুখ্যাত হয়েছেন বিজ্ঞান বক্তৃতার জন্য। ফিজিক্সের ভাল ছাত্র। ঠিক করলেন বিজ্ঞানে তাঁর যে আনন্দ তা একলা ভোগ করা ঠিক নয়, তা ভাগ করে নেবেন দেশবাসীর সঙ্গে। তাতে করে দেশবাসীর বিজ্ঞানমনস্ক এবং কুসংস্কারমুক্ত হবারও একটা উপায় হবে। তাঁদের বাড়িতে তাঁর একটি অপ্রশস্ত ক আছে। লোডশেডিংয়ের আলো-আধারিতে তা দেখলে মনে হবে মধ্যযুগের কোন আলকিমিয়া চর্চাকারীর ঘর বুঝি– বোঝাই ঘর কত রকম চার্টে গ্লোবে অদ্ভুত সব ছবিতে ডায়াগ্রামে। সেখানে জড় করলেন কিছু ছেলেমেয়ে। তারা আগ্রহ করে বিশ্বপ্রকৃতির কথা শুনল আসিফের কাছ থেকে এবং তাকে আর ছেড়ে গেল না। এ যেন বুদ্ধের সেই পঞ্চবর্গ শিষ্যদের ঘটনা। বুদ্ধের কাছে জগৎসত্য পেয়ে চর্তুদিকে ছুটল তাকে ধর্ম করে জগতে প্রচার করতে। আসিফের ছেলেমেয়েরা এখনও আসিফের পপুটে থেকে আগুন জ্বালাবার একটা ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে– জ্ঞানের আগুন। আসিফ তাঁর দলকে বাদ দিয়ে নিজের কোন কীর্তি প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেন না। তাঁর বলবৃদ্ধি হয়েছে, তাঁর দলের ইতি বিজ্ঞান লিখতে আরম্ভ করেছে, রসায়নশাস্ত্রে মাস্টার্স করে বেড়িয়েছে, বড় করে দলের ভার নিতে পারছে এখন। আসিফের প্রচেষ্টার সমবায়ী তথা কালেকটিভ চরিত্রটি প্রকাশ পায় তার দলের নামটি থেকে। ডিসকাশন প্রজেক্ট। কি ভেবে এই নামটি রেখেছিলেন জানি না। আরম্ভে হয়ত তার সেই অ্যালকেমিষ্টের গোপন গুহায় মিলিত বিজ্ঞানে নব অনুরাগীয় দল বিজ্ঞান আলোচনাই করত আসিফের সঙ্গে।
আসিফের সাহসটা কোথায়? অসচ্ছল সংসারের আসিফ মাস্টার্স শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি চাকরি করবেন না। বিজ্ঞান প্রচারই হবে জীবিকা। আরম্ভ করলেন ডিসকাশন প্রজেক্টের ঘরোয়া বৈঠক। এবং, অনন্তর, দর্শনীর বিনিময়ে বিজ্ঞান বক্তৃতা। আট বছর হয়ে গেল, তার এখনও একমাত্র আয় দর্শনীর বিনিময়ে বিজ্ঞান বক্তৃতা থেকে। একটা নিতান্ত অভিনব কল্পনা, নিতান্তই অবাস্তব, তার ওপর তিনি জীবনটা বাজি ধরলেন - সাহসটার সেখানে শুরু। চালিয়ে যাচ্ছেন যেভাবে, লড়ছেন যেন রীতিমতো। পাশাপাশি আরম্ভ করেছেন লেখা। পড়া, বক্তৃতার ব্যবস্থা করা, বক্তৃতা তৈরি করা ও দেয়া, দল চালানো, লেখা-সময়ে কুলাবার কথা নয়। তার ওপর থাকেন নারায়ণগঞ্জে, তাঁর সকল কাজ ঢাকায়।
গত পাঁচই জুন ছিল তাঁর বক্তৃতা, পরমাণু শক্তি কমিশনের শ্রবণকে তথা অডিটোরিয়ামে। বিষয় নত্রের জন্ম, স্থিতি, বিলয়। কেবল তো বক্তৃতা নয়। ছবি, স্লাইড রেকর্ড এবং আলো প্রপেণের সাহায্য নিয়ে বক্তব্যকে যত বিশদ করা যায়, সব আয়োজন ছিল তাঁর। উপস্থাপনাটি ছিল রীতিমতো নাটকীয়। মাত্রই এক মাস আগে দেশময় বয়ে গেছে এক বুজরুকির ঝড়। পাঁচটা গ্রহ, চাঁদসহ এক সরলরেখার অবস্থানে চলে আসবার ফলে যেন সৌরজগতে একটা কি ঘটে যাবে, হয়ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে– চলেছে প্রচারণা এবং বিশ্বাস করেছে লোকে। কোথায় গ্রহ কোথায় উপগ্রহ দেশের কেউই বিশেষ তার খোঁজখবর রাখে না। কিন্তু গ্রহঘটিত কারণে একটা মহাজাগতিক সর্বনাশ হতে পারে, এটা চট করেই বুঝে ফেলে। সে েেত্র এই বক্তৃতা খুবই সময়োপযোগী ও সাহসিক হয়েছে। কোন তত্ত্বাবরণ তাঁর ল্য ছিল না। এ পর্যন্ত যা কাজ হয়েছে কসমোলজিতে, অ্যাষ্ট্রোফিজিক্সে, তারই ভিত্তিতে একটি প্রাঞ্জল বক্তৃতা। একটি তারার শত শত কোটি বৎসরের জীবনকে দেড় ঘন্টার একটি বক্তৃতায় সংপ্তি করলে যা হতে পারে তাই হয়েছে। আসিফের বাচনে দৃঢ়তা আছে, আছে প্রত্যুপন্নমতিত্ব - যা শ্রোতাতে তাঁর বক্তব্য সঞ্চালন করবার খুবই সহায়ক। কিন্তু স্লাইড প্রভৃতি দেখাবার জন্য খুবই কম আলো এবং প্রায়শঃ অন্ধকার ব্যবহার করতে হয়েছে, তাতে এক ধরনের সাসপেন্স তথা নাটকীয়তা তৈরি হলেও তা বিজ্ঞান বক্তৃতার জন্য প্রশস্ত কি না ভেবে দেখা দরকার। খটখটে আলোতেই বক্তা তার কথা বলতে পারতেন। লেকটার্নের আড়ালে শুধু তাঁর মাথাটি দৃষ্টিগোচর ছিল, আলো ছিল কম, নানা ছবি নানা ধ্বনি মিলে যেন এফেক্টটা তৈরি হয়েছিল একটা প্ল্যানেটরিয়ামের। আমার ধারণা এইটিই আসিফ সমীচীন মনে করেছেন। বক্তৃতার চাইতে যে এ অন্য কিছু হয়ে গেল। একটা যেন ভোজবাজির আবহাওয়া ছিল।
আসিফের বলবার ব্যাপারে প্রশাংসা করা ছাড়া কিছু করবার নেই। বিশেষ করে প্রশ্নোত্তর পর্বে কোন কোন প্রশ্নকারী যখন বিষয়টিতে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারটি টেনে আনতে চান, আসিফ অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে, অযথা ধানাইপানাই সম্পূর্ণ পরিহার করে, সোজাসাপটা এই গুলিয়ে ফেলবার প্রবণতাকে থামিয়ে দেন। বাংলাদেশে এটা একটা সাহসের ব্যাপার বটে। কিন্তু আসিফ, বিজ্ঞানে ও তার বক্তব্য বিষয়ে তাঁর যে আনন্দ ও উৎসাহ, সেটাকে শ্রোতাদের মধ্যে চালিয়ে দিতে পারেন, তা নয়। এটা হয়ত আসবে অনেক অভ্যাসে। এবং সম্ভবত আসিফ কোন বড় মানুষের বিজ্ঞান বক্তৃতা জীবন্ত শোনেননি, ঠিক কোন আদর্শ নেই তাঁর সামনে।
বিজ্ঞানের অনেক বড় মানুষ পপুলার লেকচার দিয়েছেন বিজ্ঞানের কথা ও মনোভঙ্গি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। মাইকেল ফ্যারাডে আমার বৈজ্ঞানিক হিরো। বই বাঁধাইর দোকানে কাজ করতেন। কোন ভাল বিজ্ঞানের বই বাঁধাইয়ের জন্য এলে বাড়ি নিয়ে আসতেন, রাত জেগে পড়ে শেষ করে পর দিন দোকানে নিয়ে গিয়ে তা বাঁধাই করতেন। এই করে বিজ্ঞানের বোধ তাঁর ভিতরে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেলে রয়াল ইনষ্টিটিউশনে তার প্রতিষ্ঠাতা ও রয়াল সোসাইটির তৎকালীন সভাপতি স্যার হামফ্রি ডেভির বক্তৃতা শুনতে যান। কয়েক দিন পরে তিনি খোদ ডেভির সঙ্গে সাাত করেন। হাতে তাঁর অত্যান্ত সুন্দর বাঁধাই দু’টি গ্রন্থ। ফ্যারাডে ডেভির কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানে চাকরি চাইলেন অথচ তাঁর কাছে কোনই ডিগ্রী-ডিপ্লোমা, প্রশংসাপত্র, সুপারিশের কাগজপত্র নেই। ফ্যারাডে শুধু বাড়িয়ে দিলেন সেই দু’টি হাতে লেখা বই। তাতে ছাপার মতো অরে লেখা আছে ডেভির সেই বক্তৃতার প্রতিটা শব্দ। ডেভি বক্তৃতায় যে সমস্ত ডায়াগ্রাম ব্যবহার করেছিরেন তা অনেক সুন্দর করে নিখুঁত করে আঁকা ছিল সেই দু’টা বইয়ে। চাকরি হলো, একেবারে ডেফির গবেষণা সহকারী হিসাবে।
সেই ফ্যারাডে কালক্রমে তাঁর কালের সবচাইতে বড় বিজ্ঞানী হন। ইংল্যান্ডের রাজা তাঁকে নিয়মিত বিজ্ঞান বোঝাবার কাজে নিযুক্ত করেন। কিন্তু সেই গরিব ঘরে ফ্যারাডে কোন দিন তাঁর উৎপত্তিস্থলকে ভোলেননি। রাজরাজড়াদের গা ঘষাঘষির গ্লানি এড়াবার জন্যই যেন তিনি বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে বিজ্ঞান বক্তৃতা করতেন। এত সহজ এবং প্রাঞ্জল করে যে অশিতি নিরর বস্তিবাসী ভিড় করে আসত তা শুনতে। তখনকার দিনের আঁকা একটি ছবিতে আছে ফ্যারাডে বক্তৃতা করছেন, অজ্ঞ মূর্খ কিন্তু আগ্রহী জনতা তাঁকে রয়েছে ঘিরে। তাদেরই এক কোনায় দেখা যাচ্ছে অজ্ঞ মূর্খ কিন্তু আগ্রহী রাজাকেও।
আসিফ হয়ত ফ্যারাডের মতো বক্তা নন কিন্তু আপাতত তিনি আমাদের একমাত্র বিজ্ঞান ব্যাখ্যাকারী, অজ্ঞ সর্ব সাধারণের কাছে। এতে আর কিছু না হোক কুসংস্কারে মজ্জাগত বিশ্বাস টলতে অনেকের। আমাদের দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক সত্যিকারের বহুশীলিত কালচার্ড মানুষও আছেন, অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের মতো। আবদুল্লাহ আলমুতী গত হয়েছেন, আমরা তাঁকে যথার্থ কাজে লাগাইনি, তিনিও নিজে তাঁর গুণগুলোর সদ্ব্যবহার করেন নি। জামাল চাইলেই অনেক বেশি বেশি পপুলার লেকচার করতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। তিনি এবং তাঁর মতো যোগ্য মানুষেরা বেরিয়ে আসবার আগে আসিফই যেন আমাদের অজ্ঞ মূর্খের দলের একমাত্র ভরসা। জামাল কেম্ব্রিজের হলেও জীববিজ্ঞানী হ্যালডেনকে তাঁর প্রভাবকারীদের একজন করে পাননি। তিনি পদার্থবিদ্যার ও গণিতের এবং মূলত কসমোলজির লোক বলে। কিন্তু জানেন তো তিনি জেবিএস হ্যালডেনে অপ্রতিরোধ্য বিজ্ঞান-বিকিরণের কথা। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ডেইলি ওয়ার্কারে পর্যন্ত। আমাদের দেশে একজনও হ্যালডেন হলেন না, হচ্ছেন না। হচ্ছেন না এমন কি সত্যেন বোস, যিনি প্রকৃত ছাত্রবন্ধু ছিলেন এবং মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার বিষয়ে যাঁর ছিল অকুন্ঠ বিশ্বাস।
আসিফ সেদিন বোনাস দিয়েছিলেন তিমি মাছের গান। নত্র থেকে তিমি - একটা ধাক্কা খেতেই হয়। কিন্তু তবু সেদিনকার দর্শনীদাতা শ্রোতারা যেন খুব ভাল একটা জিনিস পেলেন। তবে তাদের মান কিছু আহামরি ছিল না। তারা অধিকাংশই কলেজগামী ছাত্রছাত্রী হলেও। ফ্যারাডের শ্রোতাদের কথা ভেবে আসিফকে তা সয়ে যেতে হবে বৈ কি।

লেখক: ওয়াহিদুল হক, কলাম লেখক, দৈনিক জনকন্ঠ, উপসম্পাদকীয় মঙ্গলবার ২৭জুন ২০০০