ঢাকা, মার্চ ২৮, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, স্থানীয় সময়: ২:৫১ pm

নগর বলয় আসিফের আশ্চর্য অনুষ্ঠান

| ২৭ ফাল্গুন ১৪২১ | Wednesday, March 11, 2015

নগর বলয়  আসিফের আশ্চর্য অনুষ্ঠানঅফিসেই খুব কান্তি বোধ করছিলাম। ভেবেছিলাম, হাতের কাজটুকু শেষ করে তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরবো। কিন্তু তা আর হলো না। সহকর্মী এমন এক বিষয়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন, যা উপো করে তড়িঘড়ি কুলায় ফেরার উপায়ই ছিলো না আমার। আসিফের অনুষ্ঠান আছে বিকেল ৫ টায়– বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলানায়তনে। তাকে কথা দেয়া আছে, যাবো। শারীরিক কান্তি বা অবসন্নতার কারণে প্রতিশ্র”তি ভঙ্গ করলে আসিফের কতোটুকু তি হতো জানি না; আমি বঞ্চিত হতাম এক বিষ্ময়কর অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ থেকে।
প্রশ্ন হতে পারে, আসিফ নামের এ ব্যক্তিটি আসলে কে? আগে পিছে বাহুল্যবর্জিত, মাত্র তিন অরের একটি নামের অধিকারী এ তরুণকে এদেশের শিতি ও সচেতন ব্যক্তিমাত্রই চেনেন। তবুও, যাঁরা বিজ্ঞানপিপাসু আসিফ সম্পর্কে তেমন জানেন না; তাঁদের জন্যে তাঁর বিষয়ে খুব সংক্ষেপে কিছু বলে নেয়া সমীচীন মনে করছি। ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি কানে এলেই যারা দিক্জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সেই বাঙালিদের মাঝে মৌলিক জ্ঞানের চর্চা এবং সাধারণ্যে তা ছড়িয়ে দেয়ার ল্েয ১৯৯২ সালের ১৯শে মে আসিফ ‘ডিসকাশন প্রজেক্ট’ নামে এক ব্যতিক্রমী আলোচনা অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত ঘটতে থাকা নানা জাগতিক, মহাজাগতিক ঘটনা; জ্যামিতি শাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, বহির্জাগতিক প্রাণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের সর্বসাম্প্রতিক অগ্রগতি পর্যালোচনা, এসব বিষয়ে যৌথ-অধ্যয়ন— সর্বোপরি দর্শনীর বিনিময়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনার আয়োজন করাই এ সংগঠনের উদ্দেশ্য।
বিজ্ঞানবিমুখ বাঙালির জীবনে দর্শনীর বিনিময়ে বিজ্ঞান সংক্রান্ত আলোচনার আইডিয়াটাই রীতিমতো বৈপ্লবিক। এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আসিফ। তাঁর বয়েসের অন্যরা যখন ফুটবল-ক্রিকেট খেলে বা পদ্য লিখে গলমর্দন হচ্ছে, তখন তিনি যেন নেশার ঘোরেই আয়োজন করে চলেছেন বিজ্ঞান সংক্রান্ত আলোচনা অনুষ্ঠানের। তাও কিনা আবার দর্শনীর বিনিময়ে। আর এই ঘোরটা কেবল নেশার নয়; পেশার সঙ্গেও আজ জড়িয়ে গেছে তার। সূচনালগ্নে যে অনুষ্ঠানে মোটেই দু’একজন; ক্রমে সাত-আটজনের মতো শ্রোতা জুটতো, আজ শ-দেড়েকের বেশি শ্রোতা ৫০ টাকার বিনিময়ে টিকেট কেটে তা উপভোগ করছে!
দেশের একমাত্র পেশাদার বিজ্ঞান-বক্তা আসিফের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বছর দুয়েক আগে। তার জ্ঞানগর্ভ লেখাগুলো পড়ে এবং ডিসকাশন প্রজেক্ট সম্পর্কে নানা আলোচনা শুনে আমি মনে মনে তার প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। যেদিন আলাপ-পরিচয় হলো, সেদিন দেখি, তিনিও আমার এক নেপথ্যচারী ভক্ত এবং তা দীর্ঘদিন আগে থেকে। তারপর থেকে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয় আমার। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তার অনুষ্ঠানে আমার যাওয়া হচ্ছিল না কোনোক্রমেই। একটা না একটা বাধা ঠিকই আটকে দিচ্ছিল আমাকে। তাই এবারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে আমি ছিলাম স্থির নিশ্চিত। কান্ত দেহেও ১০ অক্টোবর বিকেলে তাই অফিসের নিকটবর্তী বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যথাসময়ে হাজির হলাম।
আসিফের আমন্ত্রনেই যাওয়া। কিন্তু অনুষ্ঠান স্থলে গিয়ে যাদের পেলাম, তাদের কাউকেই আমি চিনি না এবং তারাও যে আমাকে চেনে না; তা বোঝাই গেলো। একটু দমে গেলাম। অবাক হলাম এজন্যেও যে, একটু পরে যে মেয়েটি বাইরে এলো, সেই চেনা মেয়েটিও আমাকে শনাক্ত করতে যেন ব্যর্থ হলো! হঠাৎ মনে হলো, যে বিজ্ঞানকে বাঙালি সমাজে নীরস বলেই বিবেচনা করা হয়, সে সংক্রান্ত অনুষ্ঠানও বুঝি এরকম নির্লিপ্ত ও কাঠখোট্টা। অগত্যা এক তরুণের শরণাপন্ন হলাম এবং তারই বদৌলতে নাগাল পাওয়া গেলো আমন্ত্রনকারী ও বক্তা আসিফের। তিনি প্রসন্ন বদনে এগিয়ে এলেন এবং আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
মিলনায়তনে সে এক অদ্ভুত পরিবেশ। একদিকে আলোকোজ্জ্বল মঞ্চ। তার দুপাশে চিত্র ও শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং রুপালি পরদা চার দেয়ালে বিশ্বের দিকপাল বিজ্ঞানীদের বৃহদাকার প্রতিকৃতি। লো-ভলিউমে বিদেশী সঙ্গীতের সুর ভেসে বেড়াচ্ছিলো করে অভ্যন্তরে। বোঝাই যায়, যে ধরনের অনুষ্ঠান উপভোগে আমরা অভ্যস্ত এখানকার পরিবেশ তা থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। কিঞ্চিৎ বিলম্বে অনুষ্ঠান শুরু হলো এবং সূচনায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ছোঁয়া থাকা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রোতার উপস্থিতিতে আলোচনা জমে উঠলো।
আলোচ্য বিষয় কী ছিলো? না, নত্রের জন্মমৃত্যুর উপাখ্যান। ইংরেজীতে যার নাম দেয়া হয়েছে “The The Lives of Stars” খুবই গুরুতর প্রসঙ্গ। বেশ গাঢ়গভীর বিষয়াবলী। কিন্তু তাতে কি? আসিফের বলবার গুণে জটিল ও রহস্যময় বিশ্বব্রহ্মান্ড যেন এক নতুন রূপ নিয়ে আমার সামনে আবির্ভূত হলো। শীতল্যা তীরের শহর নারায়ণগঞ্জের ছেলে আসিফ। তার বক্তব্যের প্রকাশভঙ্গি ছিলো প্রাঞ্জল। উচ্চারণও ভালো। নত্র পরিচিতি এবং তার জন্মমৃত্যুর উপাখ্যান মুভি ও স্লাইড সহযোগে যেভাবে তিনি ব্যাখ্যা করলেন, তা অবাক হবারই মতো। নত্রেরা আসলে কি? তারা কি চিরস্থির। না তারাও যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় যাযাবরের মতো। আসিফ জানালেন, কালো বামন বা সাদা বামন কাকে বলে। পর্দায় প্রিেপত ছবির ওপর ছড়ি ছড়ি চালনা করতে করতে বললেন, লাল দানো, সুপারনোভা, নিউট্রন নত্র আর ব্লাক হোল বা কৃষ্ণ গহবরের ইতিবৃত্ত। বস্তুত তার বক্তব্য ছিল আপেকি তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান অবলম্বনে প্রদত্ত এক যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা সমষ্টি।
অনুষ্ঠানের মধ্যপর্বে ছিলো আকর্ষনীয় প্রশ্নোত্তর-অনুষ্ঠান। উৎসুক শ্রোতারা যার যার স্লিপে এক একটি প্রশ্ন লিখে বক্তার কাছে পাঠাচ্ছিলেন। বক্তা চমৎকারভাবে তার জবাব দিচ্ছিলেন, এতে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে প্রশ্নকর্তার সঙ্গে সঙ্গে লাভবান হচ্ছিলেন অন্যান্য শ্রোতাও! আমি নিজেও আগ্রহ সহকারে একটি প্রশ্ন পাঠাই এবং আসিফ স্মিত মুখে তার উত্তর দেন।
প্রায় দু’ঘন্টা সময় কীভাবে কেটে গেলো, খেয়ালই করিনি। সময়টা খুব বেশি নয়। তবুতও মনে হলো মহাকালের এক সুদীর্ঘ টানেল পেরিয়ে এলাম আমরা। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ছিল এক অভাবনীয় ব্যাপার। জীবনে বহু রকম গান শুনেছি। কিন্তু ডিসকাশন প্রজেক্টের অনুষ্ঠানে না-গেলে অতিকায় তিমি মাছের বিষণœতায় ভরা ওই আন্তঃনাত্রিতক সঙ্গীত শ্রবণ কি সম্ভব হতো?
অনুষ্ঠান শেষ হলে দ্রুত বাড়ি ফিরি। শরীর তখন খুবই দুর্বল রাত্রে বেশ জ্বর উঠলো। এই জ্বর জানান দিচ্ছিলো বেশ কদিন ধরেই। ওইদিন চেপে ধরলো শক্তভাবে। তারপর তিন দিন তিন রাত যে কীভাবে কেটে গেলো তা জানি না। আমি জ্বরের ঘোরে কখনো দেখছিলাম সুপারনোভা মহাবিষ্ফোরণ ঘটছে মহাশূন্যে, কখনো কানে আসছিলো হোমোসেপিয়েন্স মানুষের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের দুর্বোধ্য শব্দাবলী। চোখে পড়ছিলো পাহাড়ের মতো উঁচু পিঠের ডাইনোসররা মরে পড়ে আছে সারে সারে। অস্পষ্ট স্বপ্নের আদলে চেতনায় উঁকি দিচ্ছিলো বিগ ব্যাং এর বর্ণাঢ্য জ্যামিতিক নকশা এবং প্রায় সর্বণই কানে আসছিল আসিফের সুস্পষ্ট উচ্চারণ। প্রায়ই চমকে উঠলাম বিলীয়মান প্রজাতির বিশাল তিমির গান অথবা ক্রন্দনের ধ্বনি শুনে।
ধন্যবাদ আসিফ। আপনার অনুষ্ঠান আমার অভিজ্ঞতার পরিসর বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। আপনার মঙ্গল হোক।

অক্টোবর ২০০০ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র নত্রের জন্ম-মৃত্যু বক্তৃতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার পর লেখা। ভোরের কাগজে প্রকাশিত।

ডিসকাশন প্রজেক্ট এর একাদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আবু কায়সার: দেখতে সাধাসিধে। শহুরে ভিড়ে আলাদাভাবে কারো চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু প্রায় লাজুক ও মুখচোরা এই যুবকের কান্ডকীর্তির দু‘একটি নমুনাই যে-কোন মানুষকে বিস্মত করবে। পাণ্ডিত্যের ভারে নুয়ে পড়া স্যারগন বিমূঢ় শিার্থিদেরকে যা প্রাঞ্জলভাবে বোঝাতে গিয়ে গলদঘর্ম হন; আসিফ নামের এই যুবক সেই মহাজাগতিক রহস্যের জট খোলেন অনায়াসে। ডিসকাশন প্রজেক্ট এর দর্শনীর বিনিময়ে বিজ্ঞান বক্তৃতা শুনতে আসা হলভর্তী দর্শককে তিনি গল্প বলার ঢঙ্গে নিয়ে যান এক দূর্গম দূর্গে। সেইযাত্রা কখনো তুহীন মেরুতে, কখনো অঞ্চল সুমুদ্রে, আবার কখনো বা মহাশূন্যের গা-ছমছম ছায়াপথে। আসিফের অবাক কথকতা তাই বলে কল্পকথা নয়। সে-কতকথা জ্ঞানের বিজ্ঞানের । যুক্তি ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন হয়ে ওঠা সে এক অসামান্য কথামালা।
আসিফ একটি রতœ। তিনি অকর্তিত হীরকখন্ড। তিনি এই দেশবাসীর ভাগ্যরেখা তাকে অনাদর করলে অনাদৃত হব আমরাও। আমি প্রতিভাবান যুবকের সর্বাঙ্গীন কামনা করি।

লেখক:  আবু কায়সার