ঢাকা, এপ্রিল ১৯, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৪:০৪ am

অসাম্প্রদায়িকতার মূলে কুঠারাঘাত

| ২৬ ফাল্গুন ১৪২১ | Tuesday, March 10, 2015

avijit-with-asif.jpg২৬ ফ্রেব্রুয়ারি, ২০১৫ সাল। ফিরছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাব থেকে। সাথে আবু সাইয়ীদ, ফিল্ম ডিরেক্টর। ওখানে বসে থাকাকালে বর্তমান ছবির হালহকিকত নিয়ে আরও দুজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল। চুপ করে থাকলেও শুনছিলাম, চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত হওয়ার কথা ভাবছি। কোনো ধরণের পটভূমির মধ্য দিয়ে গেলে একটা কিশোর-তরুণ প্রজন্ম কঠিন বাস্তবতা, হতাশা পার হয়ে একটা স্বপ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে- এ নিয়েও আলাপ হচ্ছিল।
ঢাকার ছবির প্রসঙ্গ আসলে আবু সাইয়ীদ বলছিলেন, স্মার্টনেস এর সাথে ছবিতে নেতিবাচক প্রবণতাও বেড়েছে এবং চলচ্চিত্রের মতো শক্তিশালী মাধ্যমে নেতিবাচক প্রবণতা যদি নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এর পরিণতি খুব খারাপ। যেমন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় পার্থক্য তৈরি হয়েছিল কিন্ডার গার্টেনের মাধ্যমে। এরপর শিক্ষা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আমরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো। দেশের ভবিষ্যতের যারা হাল ধরবে, তারা শিক্ষার বিকিকিনির মাধ্যমে বাজারে পণ্য ও ক্রেতা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
রিক্সায় ধানমন্ডি ১৫ নম্বর নেমে সাইয়ীদ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম; তখন টেলিফোনে খবর পেলাম, বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় আর বিজ্ঞান লেখক রাফিদা আহমেদ বন্যা টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তদের দ্বারা ছুরিকাহত হয়েছেন। তাদের ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেছে। বিরক্ত হচ্ছিলাম। অভিজিৎ এর সাথে টেলিফোনে কথায়-কথায় বলেছিলাম, দেশের অবস্থা জটিল, একটু সাবধানে। যখন বাসার বিল্ডিং এর সিঁড়িতে পা দিলাম, তখন আরেক বিজ্ঞান লেখক আবুল বাসার বললো, আসিফ ভাই, অভিজিৎ রায় মারা গেছে। এটা কি সেই অভিজিৎ যার কথা আপনি বলেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি হঠাৎ করেই সময়ের স্থির জালে আটকা পড়ে গেলাম। অভিজিৎ আর নেই! তাকে আমি আর দেখতে পাব না। তার সঙ্গে কত স্মৃতি, গল্প-কথা জড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম। গণমাধ্যমগুলোর ব্রেকিং নিউজে প্রচার হচ্ছে, উগ্রপন্থীরা করেছে, জঙ্গিবাদীরা করেছে– এরকম আরও অনেক কিছু। আমি ভাবছিলাম, এটা একটা হত্যাকাণ্ড। হত্যাকারীকে শনাক্ত করে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করুক। আর এ করেছে, সে করেছে এ সমস্ত বায়বীয় কথার কোনো অর্থ নেই, প্রয়োজনও নেই।

বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতেও গণমাধ্যমগুলোতে যে আলাপ-আলোচনা প্রচার হচ্ছে, প্রকাশ হচ্ছে; সেখানে মৃত্যু আর শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি নিয়ে কেউ ভাবছেন না। তাদের আলোচনার বিষয়, কে সঠিক, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দুমাস ধরে অবরোধ হরতালে বন্ধ আছে, তার জন্য নীতিনির্ধারকদের তেমন হা-হুতাশ চোখেও পড়ছে না। তাতে মনে হয়, কিছুদিন পরে কেউ হয়তো বলেও বসতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও দেশ চলতে পারে। কোনো অসুবিধে হয় না!
এটাতো সত্যি চার হাত-পায়ের বদলে দুপায়ে হাঁটা এবং হাত ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে ৩৮ লাখ বছরের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। সে ভয়েজারের মাধ্যমে সৌরজগৎ পাড়ি দিয়েছে, চাঁদে গিয়েছে, মঙ্গলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কিন্তু এই সভ্যতার মর্মান্তিক দিক হচ্ছে, মানুষ নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের নির্ধারণে একটি সহনশীল অবস্থান আনতে পারেনি। মস্তিষ্ক বিকাশে অসংগতি আর কমপ্লেক্সকে প্রণোদনা জোগাচ্ছে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা। যেখানে জবাবদিহিতার কোনো স্থান নেই, আইনশৃঙ্খলার কোনো অস্তিত্ব নেই। অভিজিতের মৃত্যু তা স্পষ্ট করলো।
মস্তিষ্ক বিকাশে খারাপ দিক আর কমপ্লেক্স তো আছেই। তার ওপর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সামাজিকভাবে যে সুবিধার বৈষম্য দেখা দিয়েছে তাতে রীতিমতো দুটো গোত্র তৈরি হয়ে গিয়েছে। আমরা রীতিমতো ভাষাগত সমস্যার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। মানুষ মানুষকে শক্র ভাবছে। প্রত্যেকেই তার সিদ্ধান্তে অটল। এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ‘দ্য ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল’ এর লেখক স্টিফেন হকিং বলেছেন, বুদ্ধির বিকাশে গত ১০ হাজার বছরে মানব ডিএনএর উল্লেখযোগ্য মাত্রার পরিবর্তন হয়নি, সেখানে কয়েকশ বছরের মধ্যেই মানবমস্তিষ্ককে রি-ডিজাইন করা সম্ভব হবে। ১০০ বছরের মধ্যে মানবদেহের বাইরে ভ্রুণ বৃদ্ধি হবে, যা হবে বর্তমান মানবমস্তিষ্কের চেয়ে বড় এবং বুদ্ধিমত্তায় অগ্রসর।
এরপর আবার বের হলাম, একটু অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে লাগলাম। ভাবলাম, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ ছিলেন বিজ্ঞানের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। বিজ্ঞানের লেখায় ফুটে উঠছিল তার আবেগ অনুভব এবং উপলিব্ধর জগৎ। সম্প্রতি লেখার মধ্য দিয়ে তার মানবতাবাদী রূপ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তাতে বলা ছিল, আমরা প্রত্যেকে মানুষ। দ্বিতীয়ত, তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে সম্মান করা। মুক্তমনা ব্লগ নিয়ে অনেক ধরণের সমালোচনা থাকলেও এটা মানুষের অনেকের কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। যেকোনো মাধ্যমেরই বিকশিত হবার একটা সময় লাগে। মুক্তমনা ক্রমশই পরিশীলিত একটা রূপ নিয়ে বিকশিত হচ্ছিল । অনলাইন পোর্টালে বিজ্ঞানের সুন্দর লেখা খুঁজতে মুক্তমনা ব্লগের তুলনা মেলা ভার। যে মানুষ চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে তার দেহ মেডিকেল ছাত্রদের দান করে দিয়েছে, তাকে ফ্যানাটিকরা হত্যা করলো কেন? তিনি তো তার অনেক লেখায়, ফেসবুক স্ট্যাটাসে মানবতার কথাই বলেছেন। তাহলে তারা বুঝতে পারেনি কেন? তাদের অন্ধ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির স্বার্থলোভী মানুষ তাদেরকে দিয়ে হত্যা করেছে তাদের বন্ধুকে, যিনি চেতনার আলো দিয়ে তাদের সামনে অনেক কিছু তুলে ধরেছেন। যেগুলোর অনেক কিছু ভালো লাগবে, কিছু বাদ দিতে হবে। পছন্দের তো সুযোগ রয়েছেই! তাহলে তাকে মারতে হবে কেনো? ভবিষ্যতে এই জাতির বিজ্ঞান চেতনার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারতো অভিজিৎ রায়। আমি হাঁটতে লাগলাম।
ভাবলাম, জৈববিবর্তন যেখানে মানুষের চোখের রং, উচ্চতা ও শরীরের কাঠামোগত ব্যবধান কমিয়ে আনছে, সেখানে বুদ্ধিগত বিনির্মাণ এক সমস্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বৌদ্ধিকভাবে অগ্রসর ও পশ্চাদপদ মানুষের মধ্যে ব্যবধান দ্রুত হবে। কালের অনিবার্যতায় বিকাশমান প্রজাতি হিসেবে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক বিনির্মাণে অংশগ্রহণ করবেই। যদি মানুষ সরাসরি অংশগ্রহণ না করেও বুদ্ধির বলয়ে বাস করে, তাহলেও বৌদ্ধিক বিনির্মাণে ভারসাম্য রক্ষা চলবে। কিন্তু বৌদ্ধিক নির্মাণের হার যত দ্রুত হবে, ততই এই ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়ে দেখা দেবে নানান সমস্যা ও সংকটের।
দেখা দেবে বুদ্ধিবিমুখতা এবং পুরনো ধারণাকে আঁকড়ে থাকার কুফল হিসেবে ফ্যানাটিক প্রবণতাগুলো। অভিজিৎ রায়ের অভাবে সেটা আরো প্রকট হবে। এই মানবতাবাদী লেখকের হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করছি ডিসকাশন প্রজেক্টের পক্ষ থেকে।