ঢাকা, মার্চ ২৯, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, স্থানীয় সময়: ১২:৪৬ am

অতীতের ছায়া

| ২৬ ফাল্গুন ১৪২১ | Tuesday, March 10, 2015

অতীতের ছায়াঅসীম প্রান্তরে কত অনাবিষ্কৃত অত্যাশ্চর্যই না রয়েছে

আর্থার সি ক্লার্ক, আইজ্যাক আসিমভ, কার্ল সাগান-এর নাম আমরা ভিন্ন ভিন্নভাবে জানি। জানি বর্তমানের স্টিফেন হকিং-এর নামও। কাজের ক্ষেত্র ভিন্ন হলেও তাদের বিষয় ছিল বিজ্ঞান। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিজ্ঞানকে একাডেমির চৌহদ্দি থেকে বের করে এনেছেন এবং মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার ব্রত পালন করেছেন জীবনব্যাপি। বিজ্ঞানের অর্জনগুলোকে জানা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর যেকোনো মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতার মধ্যেই তা পড়ে। ইভান ইয়েফ্রেমভও ছিলেন এরকম ধারারই একজন মানুষ। বিজ্ঞানকে মানবিক ইচ্ছাগুলোর অংশ হিসেবে দেখেছেন। ইয়েফ্রেমভ ক্লার্ক ও আসিমভ-এর মতো অতটা পরিচিতি না পেলেও এই ইচ্ছাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অসাধারণ সব কাজ করেছিলেন। অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা ও ফেনার রাজ্য তার অসাধারণ সৃষ্টি। বিজ্ঞানে কৃষক, রাখাল শ্রমিক বা বিজ্ঞানীর অবদান কিভাবে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে তাই তার কাহিনীগুলোতে দেখিয়েছেন। কাহিনীকে সমাজ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন করেননি। এ সমস্ত কাহিনীগুলোই আমার কৈশোরকে স্বপ্নময় করে তুলেছিল। প্রতি সন্ধ্যায় মেরিনের নদীর পারে বসে শীতলক্ষ্যার বয়ে যাওয়াকে দেখতাম। শেষ বিকেলের আলোতে ধলেশ্বরী আর মেঘনার দিকে প্রবাহমান স্রোত মহাপৃথিবীর কথাই বলতো।
ক্লার্ক ও আসিমভদের একটু আগে। মহাজাগতিক অভিযানের যে সব বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এবং তা দিতে গিয়ে পৃথিবী ও মানবজাতিকে বিচ্ছিন্ন করেননি। অগ্রসরমান বিজ্ঞান প্রযুক্তির বর্ণনা দিতে গিয়ে সমাজ কতটা সুষম, সুবিন্যস্ত, সুরময় ও মানবিক হওয়া দরকার তা বলেছেন। নাহলে কি ধরনের বিপর্যয় আসতে পারে তা বলার চেষ্টা করেছেন। তাই অনেক লেখক বলে থাকেন, ‘সাহিত্যকে সংজ্ঞায়িত করা হয় মানব প্রকৃতির ওপর গবেষণা হিসেবে, কিন্তু ইভান ইয়েফ্রেমভ যা রচনা করেছিলেন তা ছিল মানবসভ্যতার ওপর গবেষণা।’
ইভান ইয়েফ্রেমভ একাধারে ছিলেন প্রত্নজীববিদ, পুরাতাত্ত্বিক, ভূতাত্ত্বিক, জীববিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ এবং ট্যাফোনমি নামে বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখার জনক। লেখক হিসেবে তাঁর দার্শনিক, সামাজিক-রাজনৈতিক, ভবিষ্যৎ ও সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করেছিল এমন একটি বিশেষ সমন্বয় যা ইভান ইয়েফ্রেমভের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এই বইটিতে ৮টি গল্পেও আমরা তাই দেখতে পাব।
প্রজন্মকে অনাগত সময়ের জন্য প্রস্তুত করার চেষ্টা ইয়েফ্রেমভের লেখনীতে বার-বার প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমার মতে বৈজ্ঞানিক কাহিনীর কাজ হলো, ভবিষ্যতের স্বল্প আলোয় রহস্যময় পর্দায় পথগুলো ঢাকা রয়েছে, সে পর্দা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা, যেসব বৈজ্ঞানিক কীর্তি এখনো বাস্তবে রূপ নেয়নি তাদের কথা বলা, এইভাবে বিজ্ঞানের প্রগতির সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া। অতীতের ছায়া শীর্ষক গল্প সংকলনেও এই ভাবনাগুলো ঘুরেফিরে এসেছে।
এই বইয়ের প্রথম গল্প অতীতের ছায়াতে (Shadow of the Past) অতীতের কোনো ছবি ধরাও পড়েনি, ছাপাও হয়নি। কিন্তু গল্পটি এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা বিজ্ঞানী ডেনিসিউককে ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবির সমস্যাটি নিয়ে ভাবতে প্রভাবিত করেছিল এবং এটি পৃথিবীতে হলোগ্রাফি উদ্ভাবনে সহায়তা যোগায়। রেডিয়াম নিঃসৃত পাহাড়ের পাশে একটি প্রাচীন মানমন্দিরকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে তাই এই দ্বিতীয় গল্পটির মান ‘নুর-ই-দেশ্ৎ মানমন্দির’। নুর-ই-দেশ্ৎ হচ্ছে মরুভূমির আলো। আমাদের শরীরের গতিপ্রকৃতি ও উৎফুল্লতার সাথে তেজস্ক্রিয় মাত্রাগত সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। একদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধকল এবং আরেক দিকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসু মনের প্রবাহের গতি প্রকৃতি এই নিয়ে নুরে-ই-দেশৎ মানমন্দির গল্পটিকে অদ্ভুত রোমান্টিক রূপ দেওয়া হয়েছে। বর্ণনা করেছেন এমনভাবে মনে হয় কোনো মানবীকে নিয়ে পথিক গভীর রাতে হালকা নিঃসৃত নদীর পাড়ে বসে জীবনের ভালো লাগার গল্প বলে চলেছে। ‘দেনিদের’ গল্পে বলা হয়েছে আলতাইয়ের পাহাড়ে আছে পারদ হ্রদ সত্যনিষ্ঠ এক শিল্পীর জীবনের বিনিময়ে আঁকা ছবি থেকে আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছিল সেই পারদ হ্রদের। এরকম ‘দ্য পাইপ অব ডায়ামন্ড’ নামে এক গল্পে ইয়াকুতিয়া নামক স্থানে হীরার খনির বর্ণনা দেন ইভান। তার প্রায় এক দশক পরে সে দেশের ভূতত্ত্ববিদরা ঠিক সেখানেই বিশাল হীরক খনির সন্ধান পাওয়া যায়।
ষষ্ঠ গল্পটি ‘ওলগই খরখই’। মঙ্গল উপকথায় এ নামটি নাকি শোনা যায়। শার্গান-গোবির বালুস্তরে দেখা এক ভাস্বর মৃত্যুবর্ষী কীট। শার্গান বালুস্তরে ভ্রমণের বর্ণনা পড়লে গোবি মরুভূমিতে সেই অনুসন্ধানে যেতে ইচ্ছে করবে। চাঁদের পাহাড় গল্পে সাইবেরিয়ার তুহীন পাহাড়ে আদিম মানুষের আঁকা ছবির সঞ্চয় দেখে সাইবেরিয়া ও আফ্রিকাকে এক জায়গায় মনে হবে। এই বইয়ের শেষ কাহিনী- তারার জাহাজ অসাধারণ এক গল্প। এখানে ভূতত্ত্ব-ভূমিকম্প, প্রত্নজীবাশ্মবিদ্যা, বহির্জাগতিক প্রাণ, মানবজাতির একতাবদ্ধ হওয়া, ভবিষ্যত নিয়ে এক দার্শনিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাযুক্তিক সমন্বয় ঘটেছে এ গল্পে। এই বড়ো গল্পটি এক অনুপম সংশ্লেষণ, যেন পুরো বইটিকে একীভূত করেছে।
ইয়েফ্রেমভের শৈল্পিকভাবনা তাঁর ‘খেপা’ ধারণাগুলোকে কল্পনা করতে সাহায্য করেছিল যা চূড়ান্ত বিশ্লেষণে একটি বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাসের মধ্য দিয়ে যেত। তিনি দেখে যেতে না পারলেও তাঁর কতগুলো অভিনব প্রকল্প বাস্তবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণে যে বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস গড়ে ওঠে তাকে এক ধরনের গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপনা করেছেন। শুধু তাই নয়, এর পিছনে গভীর দার্শনিক পটভূমিকে তুলে ধরেছেন। এই সৌরজগত ছাড়াও বাইরে গ্রহমণ্ডলে কোনো গ্রহে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণের বিকাশের কথা বলেছেন। তাদের দেহগঠন আমাদের মতো শুধু কার্বনভিত্তিক হবে, না অন্য কিছুও হতে পারে সে বিষয়ে চিন্তার অবতারণা করেছেন।
গল্পগুলো লেখা হয়েছে ৩০ দশক থেকে ৪০ এর দশকে। গল্পগুলোতে বলা হয়েছে পৃথিবীর অসীম প্রান্তরে কত বিস্ময়কর ও অনাবিষ্কৃত অত্যাশ্চর্যই না রয়েছে। ইয়েফ্রমভ তাদের জয় করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রজন্মের প্রতি এ আহ্বান অব্যাহত থাকবে, কখনো পরিবর্তন হবে না। বাংলা সংস্করণ সম্পাদনা-২০১৫তে এই বইয়ের বিষয়বস্তুকে ঠিক রেখে শুধু ভাষা ও বক্তব্যকে সাবলীল করা হয়েছে মাত্র। এরকম বিষয়ভিত্তিক এবং সরল উপস্থাপনের বিজ্ঞান বইগুলোকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ডিসকাশন প্রজেক্ট একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। যে বইগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সেগুলো প্রয়োজনীয় সম্পাদনাসহ প্রকাশের ব্যবস্থা করবে। সেই সাথে নতুন বিজ্ঞানের বই লিখবে বিজ্ঞানকর্মীরা। এ ব্যাপারে প্রকাশনা সংস্থা তাম্রলিপিও এগিয়ে এসেছে স্বতস্ফূর্ত অবস্থান নিয়ে। ডিসকাশন প্রজেক্ট দীর্ঘ ২২ বছর বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এবার বিজ্ঞান বক্তৃতার পাশাপাশি প্রকাশিত বইগুলোকে নিয়ে দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে ছুটে যাবে বিজ্ঞানের বার্তা পৌঁছে দিতে। বিজ্ঞান অন্ধকারের প্রদীপ। আসুন এ প্রদীপের আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেই। জ্ঞানই আমাদের গন্তব্য।
- আসিফ, বিজ্ঞান বক্তা ও লেখক