ঢাকা, এপ্রিল ১৯, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১১:৩২ am

আলোর গতিই পরম, আলো ভুবন-ভরা

| ১৯ মাঘ ১৪২১ | Sunday, February 1, 2015

আন্তর্জাতিক আলোকবর্ষ ২০১৫কলগাস গ্রহবাসীদের কাছে দিনের আলো ছিল ধ্রুব সত্য একটি ব্যাপার। কারণ তারা দেখেছে, ৬টি সূর্য অবিরাম তাদের আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। তাই ওই গ্রহবাসীরা কখনো অন্ধকার বা অচেনা রাতের মুখোমুখি হয় না। কেননা প্রতিটি সূর্যই কোনো না কোনো সময় মাথার ওপর থাকে। ফলে আলোহীন রাতের পরিস্থিতির মধ্যে এই গ্রহবাসী পড়তে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তারা বুঝতে পারে, সবগুলো সূর্য এক দিনের জন্য ডুবে যাবে। দুই হাজার বছর পর নেমে আসছে দীর্ঘ রাত। আর সেই রাতে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে এক হিংস্র উন্মত্ততায় এবং বলা বাহুল্য, হয়েছিলও তাই। এটি আইজ্যাক আজিমভের বিখ্যাত নাইটফল উপন্যাসেরই কাহিনী।
একটু আলোহীন পরিস্থিতির সুযোগ পেলে মানুষ কত বর্বর হতে পারে, তার নজির আমরা দেখেছি বিভিন্ন সমাজ সভ্যতায়। আলো ছাড়া শুধু মানব সভ্যতা নয়, প্রাণীজগতের টিকে থাকা সম্ভব নয়। এই আলোকে নিয়ে জাতিসংঘ এবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছে। ২০১৫ সালকে আন্তর্জাতিক আলোকবর্ষ ঘোষণা করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১৯১৫ সালের নভেম্বরে আইনস্টাইন তার ক্ষেত্র সমীকরণ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি দেখান স্থান-কাল, আলো ও পদার্থ পরস্পরের সঙ্গে কী নিগুঢ়ভাবে সম্পর্কিত, একে অন্যকে কীভাবে প্রভাবিত করে। এটা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রধান ধারণাও বটে। এখান থেকেই অসাধারণ এক সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে; স্থান ও কালের ব্যাখ্যায় এই আলোর গতি ছাড়া আমাদের কোনো গত্যান্তর নেই। পদার্থ বা বস্তু ছাড়া বিশ্বের কোনো অর্থ নেই। জাতিসংঘের এমন মহতি ঘোষণার পেছনে এই আবিষ্কারটির শত বছরপূর্তিও উদ্দীপনা যুগিয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৬৭২ সালে নিউটনের প্রথম প্রকাশিত গবেষণাপত্র ছিল আলোকবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় গবেষণার ফল। তিনি প্রিজমের সাহায্যে সাধারণ আলোকে লাল থেকে বেগুনী পর্যন্ত বিভিন্ন রংয়ের সমষ্টি হিসেবে দেখতে পান। রবার্ট হুকসহ অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। এই কারণে বেশ দীর্ঘ সময় পর (হুকের মৃত্যুর পর) ১৭০৩ সালে নিউটনের দ্বিতীয় গ্রন্থ অপটিকস প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি আলোকে কণিকার স্রোত হিসেবে বর্ণনা করেন। সমকালীন বিজ্ঞানী ও আলোকবিজ্ঞানের তরঙ্গ তত্ত্বের অন্যতম গবেষক ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স এই তত্ত্বের সমালোচনা করেন। আলোক সম্বন্ধে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি ৬ ইঞ্চি লম্বা ২ ইঞ্চি চওড়া একটি প্রতিফলক দূরবীন উদ্ভাবন করে তাতে কাচের লেন্সের পরিবর্তে পরিষ্কার উজ্জ্বল ধাতুনির্মিত অবতল দর্পণ ব্যবহার করেন। পরে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসাহের কারণে ৯ ইঞ্চি লম্বা ২ ইঞ্চি চওড়া উন্নত ধরনের প্রতিফলক দূরবীন তৈরী করে সেখানে প্রেরণ করেন। যন্ত্রটি আজও রক্ষিত আছে। নিউটনের অপটিকসে বিধৃত কণিকা তত্ত্ব হাইগেনসের তরঙ্গ তত্ত্বের বিরুদ্ধে বিতর্কিত তত্ত্ব হিসেবে অবস্থান করে পুরো ২০০ বছর। পরে ১৮৬৫ সালের দিকে ম্যাক্সওয়েল আলোকে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে বেরিয়ে আসা আলোর গতিবেগ ছিল একটি প্রাকৃতিক রাশিমালা। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্লাংক কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নতুনভাবে কণা ত তত্ত্বকে ফিরিয়ে আনেন। আইনস্টাইন তার ফটো-ইলেক্ট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যায় এই ধারণাকে আরো ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই ধারণাগুলোই লেজার থেকে মোবাইল ফোন প্রযুক্তিতে প্রভূত বিপ্লব বয়ে এনেছে।
১৯২৪ সালে ডি-ব্রগলির ব্যাখ্যা থেকে বোঝা গেল শুধু আলোই নয়; চলমান বস্তুজগতও দ্বৈত-ধর্মের অধিকারী। এভাবেই কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের মাধ্যমে আলো কণা না তরঙ্গ ধর্ম পালন করে, সেই বিতর্কের অবসান ঘটে।
আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে এই ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের প্রাকৃতিক রাশিমালাকে পদার্থশূন্য স্থানে আলোর গতিবেগ সকল জড় কাঠামোতে এক; উৎস বা পর্যবেক্ষকের গতির ওপর এই বেগ নির্ভরশীল নয়-এরকম একটি সিদ্ধান্ত নেন। অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আলোর চেয়ে বেশী গতিশীল কিছু নেই। এক সেকেন্ডে আলো চলে ৩০ কোটি মিটার। এই সময়ে ৭ বার পৃথিবীকে ঘুরে আসা যায়।

ইভান ইয়েফ্রেমভের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অ্যান্ড্রোমিডা, এ স্পেস-এজ টেল’। মানবজাতির একটি অংশের উন্নতি বা ভবিষ্যৎ বিকাশ নয়, লেখক দেখিয়েছেন সমগ্র মানবসভ্যতার বিকাশের একটি স্বপ্নময় কিন্তু যুক্তিসংগত অবয়ব। মহাবৃত্তীয় এক সাংস্কৃতিক সমাজের সেই স্বপ্ন পূরণে উদ্যোগী হতে হবে।মহাবৃত্তীয় সংস্কৃতিতে যোগ দেবে বাংলাদেশও
জাতিসংঘ ঘোষিত আলোক বর্ষ বা লাইট ইয়ার শুধু আলোর জন্যই নয়; তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক আলোক বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে মূলত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। পৃথিবীর ৭২টি দেশ ইতিমধ্যে এই প্রবাহে যোগ দিয়েছে।
দ্য রিপোর্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখলাম, আর্ন্তজাতিক এই বিজ্ঞানপ্রবাহে ভারত এমনকি পাকিস্তানও যোগ দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ নেই এই আয়োজনে।
সিপি স্নো ১০০ বছর আগেই বলে গেছেন, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির বিভাজন সমাজের বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। সেরকম একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ধাবমান এই শতাব্দী। এ বিপর্যয় প্রতিরোধে বাংলাদেশে ডিসকাশন প্রজেক্টও দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত আলোক বর্ষকে সামনে রেখে ডিসকাশন প্রজেক্টও একটি সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়েছে। আজ সময় হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার আলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার। আর এ জন্য দেশের সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান সংগঠনগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে ডিসকাশন প্রজেক্ট কাজ করে যাবে। সেই প্রচেষ্টার একটি প্রাথমিক রূপ হিসেবে জাতীয় পর্যায়ের ‘আলোক বর্ষ’ কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে।
আইনস্টাইন বলেছিলেন আলোর গতিই পরম, আর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘আলো ভুবন-ভরা’। আর এই থিমকে সঙ্গে নিয়েই বছরজুড়ে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আলোক বর্ষকে উদযাপন করবে ডিসকাশন প্রজেক্ট ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো। বিশেষভাবে নতুন প্রজন্মকে এই কর্মকাণ্ডের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে তা সুষ্ঠু মানস ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে বিশেষ সহায়ক হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের মাধ্যমে মহাবৃত্তীয় সংস্কৃতির পথে এগিয়ে যাবে সমাজ।

লেখক: আসিফ
www.thereport24.com এ জানুয়ারি ০২, ২০১৫ প্রকাশিত।