ঢাকা, এপ্রিল ২৬, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৩:৩২ am

অনন্ত নক্ষত্রের মাধুর্যে ভরা গান - পান্না

| ১২ ফাল্গুন ১৪২১ | Tuesday, February 24, 2015

অবশেষে দুই দশক পেরিয়ে একুশ বছরে পদার্পণ করলো বিজ্ঞান সংগঠন ডিসকাশন প্রজেক্ট। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অনেক ধরনের বিজ্ঞান সংগঠনের জন্ম হলেও নানাকারণে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে ডিসকাশন প্রজেক্ট একটি অনন্য সাধারণ নাম।
এদেশে বিজ্ঞানচিন্তা ও চর্চার অঙ্গনে এর আবেদন সর্বগ্রাহী,ব্যাপকতা সুগভীর। কেবল একটি নাম নয়, ডিসকাশন প্রজেক্ট শুধু একটি বিজ্ঞান সংগঠন নয়, অন্তত এদেশে নতুন এক চিন্তাধারার নাম। ১৯৯২ সালের ১৯ মে জন্মলগ্নের পর থেকেই বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে সারাদেশে ছুটে বেড়িয়েছে সংগঠনটির বিজ্ঞান কর্মীরা। প্রজ্জ্বলিত করেছে জ্ঞানের দীপশিখা, জাগ্রত করেছে মানুষের অনুসন্ধানী চেতনাকে।
ডিসকাশন প্রজেক্টের সাথে কর্মী হিসেবে আমারঅভিজ্ঞতা এক বছরেরও কম সময়ের। তবে এর সাথে আত্নীক যোগাযোগ বহু বছরের - সেই ২০০৫ সাল হতে। সে-সময় ডিসকাশন প্রজেক্টের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘সায়েন্সওয়ার্ল্ড’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হতো, যা-ছিল তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞান চিন্তা ও চেতনার কাগজ। মূলত সায়েন্স ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমেই আমি বহুদূর থেকেও সংগঠনটির সাথে চলতে শিখেছি, একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতিগঠনের স্বপ্নে নিরন্তর আবেগতাড়িত হয়েছি।
ওই সময়েরও সাত বছর পরে ২০১২ সালের ২০ জুলাই ডিসকাশন প্রজেক্ট এর সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ ঘটে। সেটি ছিল সংগঠনটির ‘দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে’ শীর্ষক ২৫১তম ডিসকাশন। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডিসকাশন প্রজেক্ট নামের এই বিজ্ঞানময় বিশ্বটি আমার নতুন এক পরিবারে পরিণত হয়ে গেছে। ১৯৯২ সাল থেকে ডিসকাশন প্রজেক্ট যে বিজ্ঞান আন্দোলনের সূচনা করে তা অদ্যাবধি চলে আসছে। ২১ বছর ধরে প্রতিকূল পরিবেশে নানাচড়াই উৎরাই পেরিয়ে এই ধারা একইভাবে বজায় রাখা খুব সহজকথা নয়। আত্মতুষ্টিতে না-ভুগেও এ কথা আমি জোর গলায় বলতে পারি যে বিজ্ঞানমনস্ক এবং শৈল্পিক বোধসম্পন্ন একটি সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টায় আমাদের এই যাত্রা আমরা অব্যাহত রাখবো। অন-র থেকেই আমি তাই বিশ্বাস করি।
২০০৯ সালের ২২ জুলাই বাংলাদেশ থেকে শতাব্দীর একমাত্র পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। ডিসকাশন প্রজেক্ট এই মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, নালন্দা (ছায়ানটের শিক্ষা কার্যক্রম), আলিয়ঁস ফ্রঁসেস দো ঢাকা, সমন্বিত শিক্ষা-সংস্কৃতি কার্যক্রম ফুলকিকে নিয়ে একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ কমিটি তৈরি করে। এর সমন্বয়ক হন বিজ্ঞান বক্তা আসিফ। ২০০৮ সাল থেকে আলিয়ঁস ফ্রঁসেস দো ঢাকার সঙ্গে যৌথভাবে এক জ্যোতির্বিজ্ঞান কর্মশালা শুরু করে। তিনমাস ব্যাপি এই কর্মশালায় ৪০ জন উৎসাহী অংশ নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশব্যাপি এক সূর্য, চাঁদ তথা জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে সচেতনাটা গড়ে তোলা। ডিসকাশন প্রজেক্ট এর সমন্বয়ে এই অভিযাত্রায় উদ্দেশ্য ছিল মানমন্দির গড়ে তোলা। সেটা না হলেও এক মহাজাগতিক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। পঞ্চগড়ের বোদা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী মাধুপাড়া গ্রামে লক্ষাধিক মানুষ হয়েছিল বলে শুনেছি। এছাড়া পঞ্চগড় স্টেডিয়ামেসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একসাথে হয়ে বাংলাদেশ থেকে দেখা শতাব্দীর একমাত্র সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য জমা হয়েছিল। ডিসকাশন প্রজেক্ট এর সমন্বয়ে যে জনসচেতনা তৈরি প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। এটা তারই ফলাফল বলে আমি মনে করি। ২০১২ সালের ৬ জুন ভেনাস ট্রানজিট পর্যবেক্ষণ এবং ৩১ আগষ্ট নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ‘নীল জোছনায় অবগাহন’ শিরোনামে নীলচাঁদ উৎসব উদযাপনে মানুষের ঢল নেমেছিল। তা এমন এক আবেগ তৈরি করে, সিন্ধুনদ, মিসরের নীলনদ, ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতাগুলো গড়ে ওঠার দৃশ্যগুলো সামনে ভেসে ওঠে।
এই সফল কর্মসূচীগুলোতে মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ আমাদের এইবার্তা দিয়ে গেছে যে এদেশের সাধারণ মানুষও বিজ্ঞানকে অনুধাবন করতে চায়, উপলব্ধি করতে চায় সকল অভূত পূর্ব এবং অদৃষ্টপূর্বকে। আর এর জন্য প্রয়োজন মানুষের নিউরনে কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক স্বপ্ন ও আবেগের অনুরণন। আমি দেখেছি এর দীর্ঘ সময়ের যাত্রীদের, দেখেছি বিজ্ঞান লেখক খালেদা ইয়াসমিন ইতি আপুকে, জেনিথ ভাইকে। তারা নিরলসভাবে কাজ করে এখানে ডিসকাশন প্রজেক্টকে এখানে পৌছে দিয়েছে। আমিও আমার যাত্রা শুরু করেছি।
মানুষ জন্মগতভাবে কৌতূহলী। দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে আমার মতো অসংখ্য কৌতূহলী প্রাণ। এসব বিচ্ছিন্ন প্রজ্জ্বলিত শিখাকে একত্রিত করে জ্ঞানের এক অনির্বাণ মশাল তৈরির লক্ষ্যে এক ঝাঁক উদ্যমী বিজ্ঞানকর্মী নিরন-র আর নিরলস ছুটে চলেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এই দেশে যখন যেখানে সম্ভব। আর এই ছুটন্ত স্রোতধারার উৎসমুখই হলো বিজ্ঞান সংগঠন ডিসকাশন প্রজেক্ট। আমাদের গতি হতে পারে ধীর, কিন্তু স্থির। আমাদের দৃষ্টি নিবিড়ভাবে নিবদ্ধ কেবল একটি গন্তব্যের দিকে। আর তাহলো একটি জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা, মানুষের সহজাত শিল্পবোধকে জ্ঞানের পথে পরিচালিত করা। জ্ঞানই আমাদের গন্তব্য।
মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য শুদ্ধ জ্ঞানচর্চার কোন বিকল্প নেই। আসিফ ভাই এবং ডিসকাশন প্রজেক্টের সাথে আমিও এক আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার মিলনমেলার স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। বুঝতে চেয়েছি জ্ঞানের ব্যাপকতাকে, তার সার্বজনীনতাকে। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের বিশালতা তার মহিমার তুলনায় আমরা কতোখানি তুচ্ছ আর ক্ষুদ্র, তা যেদিন আমরা অনুভব করতে পারবো, বুঝতে পারবো এই পৃথিবী হচ্ছে মহাজাগতিক মহাসমুদ্রের এক নামহীন বেলাভূমি মাত্র, শুনতে পারবো মহাকালের স্রোতে ভেসে আসা অনন্ত নক্ষত্রের মাধুর্যে ভরা গান; সেদিনই আমরা প্রবাহিত হতে পারবো মহাজাগতিক সংস্কৃতির পথে।