ঢাকা, মে ১১, ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ৯:২৮ am

বিজ্ঞানচর্চা : জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য না অসৎপথে অর্থ উপার্জনের জন্য

| ২৭ ফাল্গুন ১৪২১ | Wednesday, March 11, 2015

asif-muslim-hall-2.jpgইংরেজরা এ অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার সূচনা করেছিল। পশ্চিমের চেতনা আসার ফলে এ অঞ্চলের কিছু মানুষের মনে পরিবর্তনের চেতনা সঞ্চারিত হয়েছিল। পুরাতনকে বিদায় এবং নতুনকে সংবর্ধনা জানানোর ক্ষেত্র তৈরিতে ইংরেজি শিক্ষা বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। নতুন যুগের উপযোগী প্রজন্ম তৈরির জন্য গড়ে উঠেছিল নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কলকাতার হিন্দু কলেজ ছিল এরকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উনিশ শতকের প্রথম পাদেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সমাজে নতুন যুগের বাণী প্রচারে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। এ কলেজের দুজন অসাধারণ শিক্ষক ছাত্রদের মনকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিলেন। তাদের একজন হলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং অপরজন ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন। হিন্দু কলেজে ডিরোজিও পড়াতেন নৈতিক দর্শন ও সাহিত্য। আর রিচার্ডসন পড়াতেন শুধু সাহিত্য। ডিরোজিও অবশ্য পাঠক্রমের বাঁধা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন না। বাইরের বিশাল পৃথিবীর দিকে ছাত্রদের মনের জানালাটাও তিনি খুলে দিতেন। তিনি তার ছাত্রদের স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখাতেন যেমন করে যুক্তিবাদীরা ভাবে, বিচার করে। ডিরোজিওর অনেক ছাত্র যুক্তিবাদী হয়েছিল এবং যুক্তির আলোকে বিচার করতে শিখেছিল। ঈশ্বর, পারিবারিক সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছিল। ডিরোজিও নিজে একজন কবি ছিলেন এবং অনেকে তাঁকে ইউরোপীয় বায়রণ বলতেন। হিন্দু কলেজে তাকে বেশিদিন থাকতে দেয়া হয় নি। দীর্ঘ জীবনও তিনি পান নি। মাত্র ২৩ বছরে তিনি মারা যান। কিন্তু বাংলার নবজাগরণে রেখে যান অসাধরণ প্রভাব।
ডিরোজিও জোর দিতেন লক, হিউম, পেইন প্রমুক দার্শনিকদের গ্রন্থ পড়ার ওপর। আর রিচার্ডসন জোর দিতেন শেলি, কীটস, বায়রণ প্রমুখ রোমান্টিক কবিদের রচনা পড়ার ওপর। অনেকে লিখেছেন, তার শেকস্পীয়র আবৃত্তি ও পড়ানো ছিল স্বকীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল। সামাজিক বিতর্ক ও রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ ছিলো না। সরকারের বিরোধিতা করাকে তিনি রাজদ্রোহের শামিল গণ্য করতেন। অন্যদিকে ডিরোজিও ছিলেন সরকারের সমালোচনায় নির্ভীক। এজন্য ডিরোজিওর শিষ্যরা হয়েছিলেন প্রধানত সমাজ সংস্কারক আর রিচার্ডসনের শিষ্যরা সাহিত্যিক।
ঐ সময় হিন্দু কলেজে জুনিয়র ও সিনিয়র উভয় শাখায় সাহিত্য ও নৈতিক দর্শন পাঠ্য ছিলো। সিলেকশন ফ্রম দি পোয়েটস নামক একটি বিশাল সংকলন গ্রন্থও উভয় শাখায় পড়ানো হতো। নৈতিক দর্শনের মধ্যে জুনিয়র স্তরে পাঠ্য ছিলো অ্যাবারক্রাম্বাই-এর ইনট্যালেক্চুয়াল পাওয়ারস, ওয়েটলির ইজি লেসনস ইন রিজনিং, রাসেলের মর্ডান ইউরোপ আর টাইটলারের ইননিভার্সাল হিস্ট্রি। সিনিয়র স্তরে গণিত, বাংলা, মারের বিখ্যাত ব্যাকারণ, ক্রম্বির ইটোমলজি এ্যান্ড সিনটেক্স এবং মার্শম্যানের হিস্ট্রি অব বেঙ্গল পড়ানো হতো।
শেষ দুই শ্রেণী–যাকে কলেজ বিভাগ বলা হতো, সেখানে পড়ানো হতো মিল্টন, শেকসপিয়র, পোপ এবং গ্রের কবিতা আর বেকনের প্রবন্ধ। ইতিহাসের মধ্যে পাঠ্য ছিলো হিউমের হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড, গিবনের দি ডিকলাইন এ্যান্ড ফল অব দি রোমান ইম্পায়ার, মিট ফোর্ডের হিস্ট্রি অব গ্রীস। রাসেলের মডার্ন ইউরোপ, জেমস মিলের ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি, এলফিনষ্টোনের হিস্ট্রি অব ইন্ডয়া, রবার্টসনের চার্লস (ওঠ) ইত্যাদি।
গবেষকরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন যে, হিন্দু কলেজে বিজ্ঞান পড়ানো হতো না। বঙ্গীয় সমাজে তখন বিজ্ঞানচর্চার অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু ইংল্যান্ডে অনেক আগ থেকেই বিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয়েছিল। হাতে কলমে বিজ্ঞানচর্চারও ভালো ব্যবস্থা ছিলো। হিন্দু কলেজের যে-কালের পাঠ্যক্রমের কথা আলোচনা করা হচ্ছে তার তিন দশক আগে শেলি বিজ্ঞান পড়ে কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন, রাসায়নিক পরীক্ষা করতে গিয়ে কতবার আগুন লগিয়েছিলেন, সে কথা অনেকেই জানেন। কলকাতায় বিজ্ঞান পড়ানোর প্রয়োজনীয়তা কেন ইংরেজরা অনুভব করেনি সেটা নিয়ে এখনও পর্যন্ত গবেষণা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে কেরানি আর ডেপুটি তৈরি করাই ছিলো তাদের আধুনিক শিক্ষা চালু করার মূখ্য উদ্যেশ্য। সমাজে তখনও তেমন বিজ্ঞান কর্মীর তেমন চাহিদা তৈরি হয়নি। এ কারণেও হয়তো বিজ্ঞান পড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। কারণ যাই হোক না কেন, বঙ্গীয় সমাজের নবজাগৃতি সম্পর্কে যারাই আলোচনা করেছেন তারা এর একাধিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতার আলোচনায় বিজ্ঞানচর্চার অনুপস্থিতি প্রসঙ্গটি তেমন গুরুত্ব পায়নি। বিজ্ঞান চর্চার অভাবে বাংলার নগজাগরণে কাঙ্খিত চিত্তমুক্তি ঘটাতে পারেনি। সাহিত্য ও রাজনীতি অন্ধভাবাবেগের ঘূর্ণাবর্তে হাবুডুবু খেয়েছে। দূর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার অতিক্রম করার সার্থক নেতৃত্ব তৈরি করতে পারে নি। জাগরণ, সংগ্রাম, রক্তদানও তাই সাধারণ মানুষকে মুক্তির স্বর্গে নিয়ে যেতে পারেনি।
শত অসুবিধার মধ্যেও ভারত ও পাকিস্তান পরমাণু শক্তিধর রাস্ট্র হিসেবে আতœপ্রকাশ করেছে, বাংলাদেশের অবস্থান সেক্ষেত্রে অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এখানে পাকিস্তান আমলে যেটুকু বিজ্ঞানচর্চা ছিলো তার বিস্তার ঘটানো দূরে থাক সেটুকু সংরক্ষণ করাও সম্ভব হয়নি। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিজ্ঞানচর্চার যে ধারা চলে আসছিলো তার কাঠামোটা এখনও আছে কিন্তু প্রাণশক্তি বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। হাতে কলমে শেখার জন্য পরীক্ষায় কিছু নাম্বার বরাদ্দ আছে ঠিকই কিন্তু সম্মানজনক ব্যাতিক্রমবাদে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রাকটিক্যাল ক্লাস করতে হয় না। যে কারণে এদেশের ডাক্তারদের মান নিুমূখী। প্যাথোলজিক্যাল রিপোর্ট অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি চালাবার জন্য দক্ষ জনবলের অভাব প্রকট। মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা গবেষণা ও মৌলিক বিজ্ঞান অধ্যায়নে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলে জীবনে মোক্ষলাভ হবে বলে ভাবছে। ইদানিংকালে সেভাবনায়ও ভাটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দেশকে সমৃদ্ধ করা, জাতিকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাবার মনোভাব থেকে বিজ্ঞানচর্চার কোন সংস্কৃতি এদেশে গড়ে উঠেনি। বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যায়ন করে এদেশের কৃতি ছাত্রছাত্রীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন। কিন্তু তারা বিজ্ঞানচর্চার বিকাশ সাধনে কোন ভূমিকা রাখেন নি। একথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বিজ্ঞানের শিক্ষায়তনে বিজ্ঞান পড়া লোকেরা জাতির জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। এদের একটি অংশ দূর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত না হলে জাতির উন্নতি-অগ্রগতির ছবিটা কিছুটা হলেও ভিন্নতর হতো। ছাত্র জীবনে এরা ভাল ছাত্র ছিল। জীবিকা অর্জনে বিজ্ঞান শিক্ষা সহায়ক হবে বলে এরা বিজ্ঞান অধ্যায়ন করেছিল। ছাত্র জীবনে অনেকে ভেবেছিল, ডাক্তার হলে একজন রোগীকে দেশের পীড়িত নাগরিক গণ্য করে তাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে সে দৃষ্টিভঙ্গির স্বাক্ষর তারা রাখতে পারেন নি। রোগীকে দেখেছেন উপার্জনের উপায় হিসেবে। প্রকৌশলী হবার সময় যারা ভেবেছিল একখন্ড লোহাকে দেশের সম্পদ বলে গণ্যকরবো তারা অনেকেই কর্মজীবনে উন্নয়নের কর্মসূচীকে দেখেছেন ভাগ্য গড়ার সুযোগ হিসেবে। সে কারণে রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট আয়ু পায় না। দেশপ্রেম বিবর্জিত রাজনীতি এজন্য ঠিকাদার, কন্ট্রাকটর, প্রকৌশলীকে দায়ী করে না। প্রকৃচি মূলত বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের লোকদের জোট। এ জোট প্রশাসনিক ক্যাডারদের সঙ্গে দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় অনেকটা এগিয়ে।
বিজ্ঞান হচ্ছে আধুনিক জীবনের ভিত্তি এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের চাবিকাঠি। আজকের দিনে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রন করছে বিজ্ঞান। মানুষের অর্থনৈতিক কল্যান সাধনে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ক্রমেই বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানের উন্নতি দেখে বোঝা যায় একটা দেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কতটা উন্নতি করেছে। যারা বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারেন তারাই দেশ-জাতির ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা রাখেন।
বিজ্ঞান শুধু গণতন্ত্রের নয়, বিশ্ব মানবতার সর্বোত্তম আশা। বিজ্ঞানের একজন মার্কিনী পৃষ্ঠপোষক ডব্লিউ স্ক্রিপস যার বিজ্ঞান সম্পর্কে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ছিল না তবে সংবাদপত্রের প্রকাশক হিসেবে বিপুল সুনাম অর্জন করেছিলেন, তিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে বলেছিলেন যে গণতন্ত্রকে নিরাপদ করার একমাত্র পথ হচ্ছে একে আরো বিজ্ঞানসম্মত করা। যারা বিজ্ঞানী নয় সেই আম জনতাকেও বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখতে হবে যাতে তারা বিজ্ঞতার সঙ্গে ভোটাদিকার প্রয়োগ করতে পারে।
একটা উন্নত, সমৃদ্ধ, সংস্কৃতিবান আধুনিক সমাজ তৈরির মহতী লক্ষ্য নিয়ে বিজ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নিতে হবে। তাহলেই বিজ্ঞানের গবেষণা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে তরান্বিত করতে সক্ষম হবে। এ লক্ষ্যে ডিসকাশন প্রজেক্টকে অবিচল থেকে তার কার্যক্রমকে চালিয়ে যেতে হবে। যারা সহজে জীবিকা অর্জনের জন্য বিজ্ঞান অধ্যায়ন করেন তাদের দ্বারা বিজ্ঞানের চর্চা তেমন হচ্ছে না। ডিসকাশন প্রজেক্ট একটি ব্যাতিক্রমী ধারার সূচনা করেছে। এ ধারাটি মরুপথে গেলে দেশের ক্ষতি হবে। তাই এর দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

লেখক: সৈয়দ তোশারফ আলী
সম্পাদক, রোববার, সহকারী সম্পাদক, ইত্তেফাক