ঢাকা, এপ্রিল ১৯, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১০:১৭ pm

চেতনার সমুদ্রে মহাজাগতিক পথচলা - আসিফ

| ১৩ আষাঢ় ১৪২৬ | Thursday, June 27, 2019

২৭ বছরের একটি পথ আমি অতিক্রম করেছি। সময়টা একজন মানুষের জীবনে কম নয়, কাজের ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই। এভাবে বক্তৃতা দিয়ে এত দীর্ঘ সময় ব্যয় করে ফেলেছি তা বিশ্বাসই হয় না। মনে হয় এই তো সেদিন। সবার সঙ্গে বিজ্ঞানের আনন্দ বিনিময়ের জন্য এই বক্তৃতা শুরু করেছিলাম।

সময় অথবা নক্ষত্রকে জানা বা মহাবিশ্বকে বোঝার জন্যই শুধু এই বিজ্ঞনচর্চা আমি শুরু করিনি। কেননা বিজ্ঞান মানে আমি বুঝেছিলাম গাছ না কাটা, জলাশয়কে ভরাট না করা, জলকে বিষাক্ত না করা, নদীকে নষ্ট না করা, তা হলে পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানো যাবে; বিজ্ঞান মানে আমি বুঝেছিলাম শুধু প্রকৃতিকে বোঝা নয়, পরস্পরকে বোঝা, সবাই মিলেমিশে থাকার গণতান্ত্রিক বোধ, সহনশীলতা, নমনীয়তা ও মানবিকতা, যাতে মানবজাতির যে অনিশ্চিতযাত্রা তার কিছুটা হলেও স্পষ্টত করার ক্ষেত্রে ক্ষীণমাত্রায় হলেও ভূমিকা রাখা।

বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে এই অভিযাত্রাকেই আমরা ডিসকাশন প্রজেক্ট বলে অভিহিত করে থাকি। ১৯৯২ সালের ১৯ মে বক্তৃতা দেওয়ার সময় যেসব শিশুর জন্ম হয়েছিল তাদের বয়সও ২৭ বছর হয়েছে। কখনো কখনো মানুষের জীবনে এমন পর্যায় আসে, যখন অনেক কিছুর সঙ্গেই সে খাপ খাওয়াতে পারে না। ১৯৮৬ সাল ছিল আমার জন্য তেমন একটা সময়। সমাজের চলাফেরা, গল্প, আনন্দ কোনো কিছুর সঙ্গে মেলে না। জীবনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ইচ্ছা জাগে। আবার বেঁচে থাকার জন্য একটা পেশারও দরকার হয়। আমার কাছে অনেক ধরনের মানুষ আসত।

একটা কারণ হলো, আমার ঘরটা ম্যাপচার্ট আর কয়েক হাজার বই দিয়ে ঘেরা ছিল। অনেকেরই এখানে এসে বসে থাকতে ভালো লাগত। আমার বড় ভাই কবি আরিফ বুলবুলের কারণেও অনেকে আসত। মাসছয়েক ধরে অনেকের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গে বলতাম, এত লোক আমার কাছে আসে আর আমার কাছে এসে আস্থা ভরে কথা শোনে। তারা যদি বিষয়টি একটি নির্দিষ্ট দর্শনীয় মাধ্যমে করে তা হলে আমি আমার এই জীবনে থাকতে পারি, পড়াশোনা করতে পারি আর বয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াতে পারি। পরবর্তী জীবনে এই সময়টা আমাকে নির্মাণ করেছিল। সকাল ১০টায় ঘুম থেকে উঠতাম। মগ্নতা নিয়ে চা খেতাম। এর পর দুপুর ১২টার দিকে শীতলক্ষ্যার পাড়ে ৫ নম্বর ঘাটে এসে দাঁড়াতাম, কেউ না কেউ আমার সঙ্গে থাকত। প্রায় ১০ বছর এরকমভাবে চলেছে।

নদী দেখতে ভীষণ ভালো লাগত আর বলতাম মানুষও নদীর মতো বয়ে যায়। সে কখনো এক জায়গায় থাকে না। তার পরও সে তার চিরস্থায়ী আসনের জন্য এমন সব বিপর্যয়কর কাজ করে যায়! নদীর ধারে যখন দাঁড়াতাম, মনে হতো-শরীরটা বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ওই সময় ১৫ দিন পরপর শীতের দুপুরগুলোতে বের হয়ে পড়তাম। খোলা মাঠে বা ডাঙায় বসতাম। এমনভাবে বসতাম যাতে কেউ দেখা করতে এলেও অন্তত পাঁচ মিনিট তাকে হাঁটতে হয়। তখন এত কোলাহল ছিল না। এগুলোই ছিল আমার লার্নিং সেন্টার বা জ্ঞানকেন্দ্র। ঢাকায় বাইরের দেশের যতগুলো গ্রন্থাগার ছিল, প্রতিটির সদস্য আমি হয়েছিলাম।

প্রতি ১৫ দিনে একবার যেতাম, প্রায় ১৫টি বই নিয়ে ফিরে আসতাম। গ্রন্থাগারগুলো হলো-ভারতীয় হাইকমিশনের গ্রন্থাগার, ব্রিটিশ কাউন্সিল, আমেরিকান কালচারাল সেন্টার গ্রন্থাগার, জার্মান কালচারাল সেন্টারের লাইব্রেরির সদস্য হয়েছি। তখনো বিশ্বের মানুষ গ্রন্থাগারকে গুরুত্ব দিত। এখন না দেওয়াটাকে অস্বস্তিকর লাগে, সবাই বলে ইন্টারনেট তো আছে। এটাকে অধঃপতনই মনে হয়। সেই সময় অসাধারণ এক বন্ধু ছিল : যে আমাকে হাজার দশেক টাকার বই কিনে দিয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও রিলেটিভিটির ওপর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই ছিল।

বইগুলো কতটুকু কাজে এসেছিল জানি না। আমারই বয়সী একজনের আমার প্রতি এই ভালোবাসা জীবনকে গভীরভাবে আপ্লুত করেছিল। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো-বৈজ্ঞানিক ভাবনা ও ধারণার সঙ্গে ছোটবেলার সেই আবেগকে একত্রে চালিত করা। এটিই আমার জীবনের ব্যর্থতা, সফলতা বা সর্বনাশা পথের সূচনাকাল। জার্মান লাইব্রেরিতে যাওয়ার সুবাদেই আমার শিল্পী এসএম সুলতানের সঙ্গে দেখা হয়। একসঙ্গে মোজার্টের ম্যাজিক ফ্লুট, নাইন সিম্ফনি শুনেছি। আমিই পছন্দ করেছি। তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। প্রথমে তো আমি চিনতাম না। লাইব্রেরিয়ান জামান ভাই বললেন, কী বলেন, তিনি সুলতান!

চমকে গিয়েছিলাম, আলোড়িত হয়েছিলাম, সালভাদর দালী ও পাবলো পিকাসের সঙ্গে তার ছবিও পৃথিবীতে প্রদর্শিত হয়। সেই সময় তিনি স্বাস্থ্যবান কৃষকদের ছবি এঁকে চলেছেন। তার এসব ছবি আঁকার বেশ কিছু দৃশ্যও দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। মিউজিক আর তার কৃষকদের নিয়ে তার কাজের কথা মনে হলে আমার মধ্যে এক ধরনের ঘোর তৈরি হতো- পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানীরা ছিলেন কৃষক, নাবিক আর তাঁতিদের সন্তান। ১৯৮৮ সালে সংবাদে প্রকাশিত ওয়াহিদুল হকের বৈজ্ঞানিক নিঃসঙ্গতা প্রবন্ধটি পড়ে আমি রীতিমতো অভিভূত হয়েছিলাম। তারুণ্যের প্রারম্ভে ওই সন্ধ্যায় ফ্যানের হালকা বাতাসে আমি যুক্ত হয়েছিলাম অসাধারণ অভিজ্ঞতার। আমার পরিষ্কার মনে আছে, প্রবন্ধটি পড়ার পর আমি চুপচাপ বসেছিলাম।

কেউ সামনে এলেও সাড়া দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না। কিন্তু ভেতরে ছিলাম ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত। সামনে চলার এক দুর্দান্ত উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ রেখাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। বিজ্ঞান, শিল্প, মিউজিক আর রাজনীতি কীভাবে মিলেমিশে যায় একটি লেখায় তাই অনুভব করেছিলাম। একজন মানুষ তো এগুলোর মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে। এসব অর্জনকে সামনে রেখে শুরু হয়েছিল ডিসকাশন প্রজেক্টের কাজ। এই অভিযাত্রা শুরু করেছিলাম জ্যামিতির নানা দিক নিয়ে। ইউক্লিডীয় স্বীকার্যের সাপেক্ষে কীভাবে যৌক্তিক সব কাঠামো গড়ে ওঠে। কীভাবে পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ বাঁধ দিলে জ্যামিতে তিন কোণের সমষ্টি পরিমাপ করা যায় না।

রেখাগুলো তার দৃঢ়তা হারায়। বহির্জাগতিক সভ্যতার আলোচনায় মানুষের কি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করেছি। বহির্জাগতিকরা কি আসবে? আসতে গেলে তো টিকে থাকতে হবে? আমরা কি নিজেরাই পাশের মানুষটিকে নিয়ে টিকে থাকতে শিখেছি? এক সমাজের সঙ্গে আরেক সমাজ সখ্য তৈরি করতে পেরেছে? এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের সঙ্গে শুধু শ্রেষ্ঠত্বে লড়াই করে চলেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ শরণার্থী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাগর-মহাসাগরে আশ্রয়ভূমির সন্ধানে। পৃথিবীর জীব হয়েও তাদের দেশ নেই।

কসমকি ক্যালেন্ডার দেখিয়েছে পুরো মহাবিশ্বের বয়স যদি এক বছর ধরে নেওয়া হয় তা হলে গুহা মানবরা ছবি এঁকেছে ১ মিনিট আর মানবসভ্যতা বর্ণমালা ব্যবহার করে লিখতে শিখেছে মাত্র ১০ সেকেন্ড। কী অল্প সময়! তার পরও মহাকাশযুগে আমরা পদার্পণ করেছি। অথচ পুরনো অভ্যাসগুলো ছাড়তে পারছি না। সমাজ বিকাশে যে গভীর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, তা আসলে বিবর্তনের দীর্ঘযাত্রায় সৃষ্ট। মস্তিষ্ক বিকাশজনিত সমস্যা। এগুলো শুধরানোর জন্য শিশুদের যে স্কুলিংয়ের মধ্যে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন তা আমরা সম্ভব করে তুলতে পারিনি, শিক্ষণ-প্রশিক্ষণকে এক করে ফেলেছি, শিখাচ্ছি শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই।

অথচ স্কুলিংয়ের কাজ ছিল মানবজাতির যা অর্জন তাকে যতটা পদ্ধতিগতভাবে শেখানো আর তার আলোয় ভবিষ্যতের পথ চলতে উদ্বুদ্ধ করা। তা পারলেই পেশাগত কাজের জন্য জুতসই প্রশিক্ষণই তাকে সমাজের কর্মক্ষম মানুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারত। সমাজে মানবিক মানুষ হিসেবে তার পেশা সম্পাদন করতে পারত। এজন্য আমি কসমিক ক্যালেন্ডার বা মহাজাগতিক বর্ষপঞ্জির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলাম। কারণ কসমিক ক্যালেন্ডার এমন একটি শেখার হাতিয়ার যেখানে মহাবিশ্ব, জীবনের উদ্ভব, লিঙ্গের উদ্ভব এবং মানুষের উদ্ভব ও এর বিকাশের এমন আনুপাতিক চিত্র দেওয়া আছে যা মনে রাখার জন্য সুবিধাজনক। যখন একটি শিশু তা জানবে এবং চর্চার মধ্য দিয়ে যাবে, প্রতিনিয়তই তা ভাবাবে তার প্রজাতির উদ্ভব, কী অনিশ্চয়তা আর অকল্পনীয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার এই অগ্রযাত্রা।

আজকে যে সুবিধার মধ্যে সে বসবাস করে তার পেছনে অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ তার ভেতরে সেই আবেগ সঞ্চারিত করবে যা স্বাভাবিকভাবে অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে সরাবে। অথচ এগুলো তো দূরের কথা, কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনকেই ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারিনি। বিজ্ঞানকে বানালাম প্রাযুক্তিক সুবিধা লাভের বস্তু, ভোগের জাদুর বাক্স। অথচ জরুরি ছিল বিজ্ঞানকে সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রবাহে চালিত করা যাতে এ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের উপযুক্ততা অর্জন করা যায়।

একটা সমাজ যখন সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক অবদানের ওপর নির্ভর করে অথচ বোধের জায়গা থেকে বিজ্ঞানকে নেওয়া হয় না; বিজ্ঞানসৃষ্ট প্রাযুক্তিক উপাদানে নিমজ্জিত কিন্তু বিজ্ঞান থেকে দূরে কোনো সমাজের পরিণতি মঙ্গলজনক নয়। ইতিহাসে অনেকবার এমনটাই ঘটেছে। তারই বর্ণনা করেছি মানব প্রজাতির অনিশ্চিত গন্তব্য, পৃথিবীর সব গল্প ফুরানোর আগে।

এ ছাড়া আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অবলম্বনে ‘সময়ের প্রহেলিকা, নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু নিয়েও আলোচনা করেছি; ওরা কেন আসেনি, পৃথিবী কী টাইপ ওয়ান সভ্যতায় পৌঁছতে পারবে? সম্ভাবনাময় মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭৯ ওপেন ডিসকাশনসহ প্রায় ৩০০-এর মতো বিজ্ঞান আলোচনা সম্পন্ন করেছি। এগুলো করতে গিয়ে ঢাকা থেকে সন্দ্বীপ, আবার নীলফামারী হয়ে পঞ্চগড় পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছি।

প্রায় ৬০ হাজার দর্শক-শ্রোতার মুখোমুখি আমরা হয়েছি। পঞ্চগড় মাধুপাড়া গ্রামে, শতাব্দীর শেষ সূর্যগ্রহণ অবলোকন একসঙ্গে ৫০-৬০ হাজার মানুষ যখন চাঁদ ও সূর্যের সম্মিলনকে চিৎকার করে স্বাগত জানাচ্ছিল তা আমার কাছে মহাপৃথিবীর কথাই বলছিল। পেশাদারি বক্তৃতায় নামার পর আমার কাছে আসা মানুষের মধ্যে স্কুলছাত্র থেকে আরম্ভ করে মসজিদের ইমাম সাহেব ছিলেন। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোররাও এসেছিল তাদের সংকটকালের বার্তা নিয়ে? এসব অভিজ্ঞতা আমার দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছে।

দেখেছি বিকাশমান জীবনের উজ্জ্বল আলোকমালা। একবার সস্তাপুর থেকে চানমারি গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনে এক সাদা দেয়াল দেখে চমকে গিয়েছিলাম। চারদিকে হলুদ শস্যক্ষেতের গাছগুলো বাতাসে দুলছিল। দেয়ালের অপর পাশটাকে বিশাল কোনো প্রেক্ষাপটের আভাস দিচ্ছিল, নিজের ভেতরটা আলোড়িত হচ্ছিল। শুরু হয়েছিল চেতনার মহাজাগতিক সমুদ্রের যাত্রা। আহ্বান থাকল নবপ্রজন্মের প্রতি আরও দীর্ঘপথ অতিক্রমে, মহাজাগতিক জীবনের লক্ষ্যে।

আসিফ : বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত